সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ ও মানবমুক্তি শুরুর অধ্যায়

শিপ্ত বড়ুয়া

সিদ্ধার্থ যেভাবে রাজপ্রসাদ ছেড়ে গৃহত্যাগ করেছে তা নিয়ে বিভিন্ন সমালোচকবৃন্দ বিরূপ মন্তব্য করেছেন। অনেকে বলেছেন সিদ্ধার্থ তার পিতা, সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ও ফুটফুটে পুত্র সন্তানকে হৃদয়হীনভাবে ত্যাগ করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন শুধু। কিন্তু সিদ্ধার্থ এভাবে নিরবে গৃহত্যাগ না করে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিতে চাইলে তাহলে আসলেই তা সম্ভব হতো কি?

রাজপুত্র সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত ছিলো সময়ের সঠিক পদক্ষেপ।

কখনোই হতো না এবং এনিয়ে কোন সমালোচক কথা বলেন নি, তাছাড়া আনুষ্ঠানিক বিদায় সম্ভব হতো না কারণ তার পিতা, স্ত্রী এবং প্রিয় সন্তানের আদরমাখা চেহারা তার মনকে অস্থির করে রাখতো এবং তারাও চেষ্টা করতেন যে সিদ্ধার্থকে গৃহত্যাগে বাঁধা দিতে।

সিদ্ধার্থ জেনেছিলেন আনুষ্ঠানিক বিদায় নিতে চাইলে তার পিতা রাজা শুদ্ধোধন তার ছোট রাজ্যে মশগুল লাগিয়ে দিতেন এবং আরো অনেক কিছুই করতে পারতেন। নিরবে গৃহত্যাগ না করলে মানবজন্মের দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়ার খোঁজ তিনি কখনোই করতে পারতেন না। পিতা শুদ্ধোধন এবং স্ত্রী যশোধারা আগে থেকেই চেষ্টা করছিলেন সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ আটকাতে।

২৯ বছর বয়সে সিদ্ধার্থ খুবই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও জীবনের শ্রেষ্ঠ যৌবনাদীপ্ত ছিলেন। যেহেতু তিনি সত্যের অন্বেষণ ও মানব দুঃখ মুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন তৎমুহুর্তে তিনি চিন্তা করেছিলেন যে এই সময়ে আমি যদি রাজসম্পদ, সুন্দরী স্ত্রীর প্রলোভনে পড়ে যাই আমার আর বুদ্ধত্ব লাভ করা সম্ভব হবে না, সত্যের দ্বার বন্ধই রয়ে যাবে।

যেদিন সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করবেন শেষবারের মতো রাতে তার শোবার ঘরে গিয়ে একপলক তার ঘুমন্ত স্ত্রী ও সদ্যজাত পুত্র সন্তানের দিকে তাকিয়েছিলেন। সে মুহুর্তে গৃহত্যাগের মতো ভিন্ন একটি পন্থা তিনি কেনো নিলেন এই ভেবে তার মনে চাপা যন্ত্রনার অনুভূতি হলো এবং অনেকক্ষণ তিনি সেখানে নিরবে কাঁদলেন।

অবশ্য ভারতে সেসময়ে আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে যারা গৃহত্যাগ করতেন এবং তপস্বী হওয়ার চেষ্টারত ছিলেন তাঁদের মহৎ ব্যক্তিরূরে বিবেচিত করতেন। সিদ্ধার্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নেওয়া প্রতিটা পদক্ষেপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে গৃহত্যাগের উপায় থেকে সকল কাজ তিনি সঠিক সময়ে ভেবে চিন্তে করেছেন এবং তাই তার অন্তিম গন্তব্যে তিনি পৌঁছাতে পেরেছেন।

সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ কিংবা বুদ্ধত্ব লাভ শুধুমাত্র তিনি তার নিজের দুঃখমুক্তির জন্য করেন নি বরং পৃথিবীর সকল মানবের দুঃখমুক্তির অভিপ্রায়ে করেছিলেন। তিনি মনে করতেন সমগ্র পৃথিবীর মানবজাতি একটিই পরিবার এবং আমরা সবাই সে পরিবারের সদস্য। সুতরাং বলা যায় রাজপুত্র সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো।

বুদ্ধত্বলাভ এবং সত্যের অন্বেষণের জন্য একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা ও সংসারের মায়া ত্যাগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে করেছিলেন সিদ্ধার্থ। তিনি প্রথমেই তৃষ্ণা ক্ষয়ের মাধ্যমেই জ্ঞানের প্রজ্জোলিত পথটি ধরে হেঁটেছেন এবং এভাবেই জ্ঞান অর্জনের অধ্যায় শুরু হয়। তিনি অনুধাবন করেছেন, বেশিরভাগ মানুষের জীবনে দুঃখ নেমে আসে সম্পর্কে আবদ্ধ থাকার কারণে এবং নতুন নতুন সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে দুঃখের সুত্রপাত ঘটে।

আর আমরা এসব সম্পর্কের জেরেই প্রায়সময় রাগান্বিত হয়ে উঠি, চিন্তা আমাদের গ্রাস করে এবং অনেক সময় লোভের বশবর্তী হয়ে এসব অনাচারের বিরুদ্ধে অন্যকে অভিযোগ করি এবং এগুলোর কারণে গালমন্দ করতে হয়। নিরানন্দ, দুঃচিন্তা, বিষন্নতা এবং কষ্ট আমাদের স্পর্শ করতে পারে কেবল আমরা সম্পর্কের জালে আবদ্ধ থাকি বলেই।

যখনই এসব চিন্তা এবং সমস্যা কেনো হচ্ছে এব্যাপারে খতিয়ে দেখবেন এর মূলে সবসময় সম্পর্কের বন্ধনকে খুঁজে পাবেন। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ উপলব্দি করেছিলেন যে আপাতত তিনি তার রাজদরবার, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখেই আছে এবং তিনি যদি এ সম্পর্কের বন্ধন চূড়ান্ত করে তাহলে দুঃখ তাকে একদিন না একদিন গ্রাস করবেই এবং তিনি যদি এই বন্ধনে থেকে যায় সর্ব মানবের দুঃখ উপশমের উপায় বা বুদ্ধত্ব লাভ তিনি করতে পারবেন না।

সুতরাং একথা আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, সর্ব মানবের কল্যাণে এবং দুঃখ মুক্তির সন্ধান করতে গিয়ে সিদ্ধার্থ তার পরিবার এবং পার্থিব আনন্দসহ সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন।

তখনকার সময়ে প্রাণোদীপ্ত তরুণ রাজকুমার সিদ্ধার্থ দেখেছিলেন সারা বিশ্ব কি তবে যৌনক্ষুধায়, রাগে, কষ্টে এবং আরো হাজার রকমের সমস্যায় জ্বলতে থাকবে আর মানুষের আবেগে এসবের আগুন জ্বলতে থাকবে! তিনি উপলব্দি করতে পেরেছিলেন পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় বসবাসকারীগণ এমনকি তার স্ত্রী-পুত্র শারিরীক ও মানসিক নানান জটিলতায় ভুগেন।

মূলত এসব বিষয় তাঁকে বারবার পীড় দিয়েছিলো এবং একারনেই তিনি মানবজীবনের দুঃখ থেকে মুক্তির সম্পূর্ণ উপায় খুঁজতে থাকলেন, এসবের জন্য তিনিই এতই উতগ্রীব ছিলেন যে শেসমেষ সবকিছু বিসর্জন দিতে পিঁছপা হননি।

বুদ্ধের সময় থেকে ২৫০০ বছর পরে এসে কোন কোন সমালোচক কার গৃহত্যাগের পদ্ধতিকে ভুল তমকা মেখে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে যা কাম্য নয়। যেখানে সিদ্ধার্থের প্রিয়তম স্ত্রী যশোধারা সিদ্ধার্থের মূল কারণ অনুধাবণ করতে পারার পর স্বাছন্দে-শ্রদ্ধায় তা মেনে নিয়েছিলেন, সিদ্ধার্থের প্রতি তাঁর কোন অভিযোগ ছিলো না। পরে তিনি শ্রদ্ধায় রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সাধারণ জীবন-যাপন শুরু করেছিলেন।

একজন বিখ্যাত কবি ও লেখক বুদ্ধের গৃহত্যাগকে বলেছেন এভাবে :

তার আদরের সন্তানের প্রতি ঘৃণা থেকে নয়
প্রিয়তম প্রেমিকার তীক্ততায় নয়
তার হৃদয়ের ঢেউয়ের জন্য – তিনি তাঁদের ভালোবাসতেন
কিন্তু বুদ্ধ হতে হবে, যা তাঁকে সবকিছু ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলো।

Archetype : K. Sri Dhammananda, What Buddhist Believe (Fifth Edition 1993, budaedu), (The Last Message of the Budhha, 39.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *