মুঘলদের রামু বিজয়ের ঐতিহাসিক ইতিহাস (৩য় ও শেষ পর্ব)

শিরুপন বড়ুয়া

মুঘলরা রামু দুর্গ জয় করার পর আত্মগোপনে থাকা আরাকানি গভর্নর রাউলির সৈন্যরা আবারো আক্রমণ করতে পারে এই আশংকায় থাকা মীর মুর্তজা তাঁর বাহিনীর একাংশকে বাকখালীর দক্ষিণ পাড়ে রাজারকুলে মোতায়েন করে রেখেছিলেন। তাঁর আশংকাকে সত্যি করে একদিন আচমকা আরাকানি সৈন্যরা সাতটি বিশালাকার হাতি নিয়ে হামলা করে বসে মুঘল বাহিনীকে। নদীর অপর পাড়ে (বর্তমান ফতেখাঁরকুল) অবস্থান করা মুর্তজা হামলার খবর শুনেই বাকি সৈন্যদের নিয়ে বাকখালী অতিক্রম করে আরাকানিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। আরাকানিরা আবারো পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে বেশ কিছু আরাকানি সৈন্য মুঘলদের হাতে বন্দী হয়, এবং তাদের কাছ থেকে ৮০ টি কামান সহ অনেক মাস্কেট (বন্দুক) এবং অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র জব্দ করা হয়।

এতবড় বিজয়ের পরও মুঘল সৈন্য সহ মীর মুর্তজা রামু ছাড়তে বাধ্য হন। এর মূল কারণ ছিল চট্টগ্রাম হতে রামুর যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঘন পাহাড়ি জঙ্গল, ছোট বড় নদী নালা এমনিতেই পথটিকে দুর্গম করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তার উপর বর্ষাকালে এই স্থলপথটির বিভিন্ন অংশ বন্যায় প্লাবিত হতো। যার কারণে বুজুর্গ উমেদ খানের আদেশে বর্ষার আগেই মীর মুর্তজা রামু ছেড়ে চলে আসেন এবং কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থান নেন।

মুঘলদের রামু বিজয়ের ঐতিহাসিক ইতিহাস (২য় পর্ব)

রামু বিজয়ের পর মুঘলরা রামুতে প্রশাসনিক দপ্তর বা কোন প্রশাসক নিয়োগ করে নি। দক্ষিণ চট্টগ্রামে অর্থাৎ রামু এবং এর দক্ষিণে আবারো আরাকান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেও, তা ১৬৬৬ সালের আগের মতো জোরালো ছিল না। এই অঞ্চলে আরাকানিদের আনাগোনা আনুমানিক ১৭৫৬ সাল অবধি বহাল থাকে। আবদুল করিম খোন্দকার রচিত ‘দুল্লা মজলিস’ নামক গ্রন্থে রামুর আরাকানী শাসকের প্রশংসা করা হয়েছে। এই গ্রন্থটি ১৭৪৫ সালে রচিত হয়।

যদুনাথ সরকার তাঁর ”Anecdotes of Aurangzib and Historical Essays’Essays’ নামের বইতে লেখেন “Rambu taken and abandoned’। অর্থাৎ রামু বিজয়ের পরপরই মুঘলরা রামু ছেড়ে চট্টগ্রামের দিকে চলে যায়, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ১৬৬৬ থেকে ১৭৬০ সালে পর্যন্ত প্রায় একশত বছরের রামু’র রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল ছিল বলে মনে হয় না। ভৌগোলিক দুর্গমতাকে জয় করে দক্ষিণ চট্রগ্রামের এই অঞ্চলে মুঘলদের সরব উপস্থিতি হয়তো ছিল না, কিন্তু তাদের হাতে পরাজয়ের পর আরাকানিরাও রামুতে আগের মতো একটি শক্ত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয় নি।

মুঘলদের রামু বিজয়ের ঐতিহাসিক ইতিহাস (১ম পর্ব)

কক্সবাজার জেলায় মুঘল স্থাপনা গড়ে না উঠার পেছনে এটাও একটা কারণ। অথচ সমসাময়িক চট্টগ্রামে কিন্তু অনেক মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। শ্রীপূর্ণচন্দ্র চৌধুরী রচিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ বইটিতে ১৬৬৬ হতে ১৭৬১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৩০ জন মুঘল ফৌজদার প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করার কথা উল্লেখ আছে। সম্ভবত সাঙ্গু নদীর উত্তর পাড় পর্যন্ত মুঘলদের বেশ ভালো নিয়ন্ত্রণ ছিল। ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম অভিযানের সময় এই সাঙ্গু নদীর পাড়ে সীমানা নির্ধারণী যুদ্ধে প্রাণ হারানো বাইশ জন সৈন্যের কবর দেওয়া হয় চন্দনাইশে। যার নাম দেওয়া হয় বাগ-ই-শাহ। চন্দনাইশের খান জামে মসজিদের দক্ষিণ পাশে সেই ২২ টি কবর এখনো আছে। চট্টগ্রামে মুঘল আমলের একদম শুরুর দিকের নিদর্শন হচ্ছে এই কবরগুলো। আজো আরাকান সড়ক হয়ে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে গাড়ির জানালা দিয়ে কবরগুলো চোখে পড়ে।

আরাকানিরা উত্তর চট্টগ্রামের দখল মাঝে মধ্যে অল্প সময়ের জন্য বাংলার সুলতান এবং ত্রিপুরার রাজাদের কাছে হারালেও দক্ষিণ চট্টগ্রামের দখল অর্থাৎ সাঙ্গু বা শঙ্খ নদের দক্ষিণ পাড়ে তাদের শক্ত অবস্থান ছিল। চন্দিলাহ রাজার শিলালিপিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলার সুলতান দাউদ কররানী শঙ্খনদ পর্যন্ত জয় করেছিলেন।

কিন্তু মুঘল সম্রাট আকবরের হাতে তাঁর পরাজয় হলে আরাকানরাজ মঙ ফালঙ (১৫৭১-৯৩) আবারো উত্তর চট্টগ্রাম দখল করে নেন। সম্রাট আকবর চট্টগ্রাম দখল করতে না পারলেও আকবরের রাজস্ব বিভাগের প্রধান দেওয়ান তোডড়মল দরবারের নথিপত্রে চট্টগ্রামকে মুঘল তৌজিভুক্ত করেন। সেটা সম্ভবত শঙ্খ নদের উত্তর পাড় পর্যন্তই। তারমানে রামুতে মুঘল গোলন্দাজ অধিনায়ক মীর মুর্তজার হাতে আরাকান গভর্নর রাউলির পরাজয় হলেও মুঘলরা রামু ছেড়ে দাউদ কররানী আমলের সাঙ্গু বা শঙ্খ নদের উত্তর পাড়েই শক্ত অবস্থান নেয়।

রামু থেকে মুঘল সৈন্য প্রস্থান করলেও মুঘলরা কিন্তু কখনই এর দাবী ছেড়ে দেয়নি। তাই ১৭৬০ সালে অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রেই ব্রিটিশরা চট্টগ্রামের সাথে রামু’র দখল লাভ করে। ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকেও চট্টগ্রাম হতে রামু’র যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ দুর্গম ছিল। চট্টগ্রাম থেকে তখন বাকখালী নদী হয়ে বিভিন্ন মালামাল নিয়ে আসা হতো। স্থলপথ এতটাই দুর্গম ছিল যে ভারী কামান এবং গোলাবারুদ নিয়ে সৈন্যরা ঘন্টায় মাত্র এক মাইল যেতে পারতো।

তারপরও ব্রিটিশরা চট্টগ্রামের পর রামুতেই তাদের নতুন ঘাঁটি গড়ে তোলে। রামু’র বাইরে ব্রিটিশদের আর কোন বড় মিলিটারি পোস্ট ছিল না। ব্রিটিশরা নাফ নদীকে অফিসিয়ালি আরাকানের সাথে ভারতবর্ষের সর্ব দক্ষিণ -পূর্ব সীমানা হিসেবে মেনে নেয় । এই ধারণা মূলত মুঘলদের রামু বিজয়ের পর থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়। আরকান রাজা মেন-খরী’র (১৪৩৪-১৪৫৯, মুসলমান নাম আলী খাঁ) রামু বিজয়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলে আরকান শাসনের শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৪৫৯ সালে বচৌপিউ (১৪৫৯-১৪৮২, মুসলমান নাম কলিমা শাহ) চট্রগ্রাম জয় করেন। ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম এবং রামুতে আরকান শাসন অক্ষুণ্ণ থাকে, যার অবসান ঘটে মুঘলদের হাতে। শ্রী চন্দ্র সুধর্ম্মা এই এলাকার সর্বশেষ আরকানি শাসক।

বি:দ্র: লেখাটি রামু’র ইতিহাস বিষয়ক গবেষণার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। মুঘলদের রামু বিজয়ের ঐতিহাসিক ইতিহাস ৩য় ও শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো।

তথ্যসূত্র-
১। মুহম্মদ এনামুল হক,আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, আরকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য, চট্টগ্রাম ১৯৩৫।
২। শ্রীপূর্ণচন্দ্র চৌধুরী, চট্রগ্রামের ইতিহাস, চট্রগ্রাম, ১২৮২ মগী।
৩। আহমদ শরীফ,চট্রগ্রামের ইতিহাস, ঢাকা, ২০০১।
৪। জামাল উদ্দিন, শাশ্বত চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, ২০১৫।
৫। W Foster, Early Travels in India 1583-1619, Oxford University Press, 1921.
৬। Jadunath Sarkar, Anecdotes of Aurangzib and Historical Essays, Calcutta, 1917.
৭। The Calcutta Review, Vol.53, Calcutta, 1871.
৮। Anjali Chatterjee, Bengal in the Reign of Aurangzib.
৯। L.S.S O’mey, Eastern Bengal District Gazetteers-Chittagong, Calcutta 1908.
১০। W.W. Hunter, The Imperial Gazetteer, Vol.3, London, 1885.
১১। Shunati Bhusan Qanungo, A History of Chittagong Vol 1, Chittagong.
১২। Sir Arthur P Pyre, History of Burma, London, 1883.
১৩। G.E Harvey, History of Burma, Calcutta, 1925.
১৪। W.W Hunter, A Statistical Account of Bengal, Vol. 6, London, 1876.
১৫। Dr. Mohamed Ali, Bengal-Arakan Relations: A Study in Historical Perspective.
১৬। Aye Chan, The Kingdom of Arakan in the Indian Ocean Commerce (Ad 1430-1666), Kanda University of International Studies, Japan.

লেখক: শিরুপন বড়ুয়া, আইনজীবী ও তরুণ ইতিহাস বিশ্লেষক।
shirubarua@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *