বুদ্ধ কীর্তন ও বাঙালির ঐতিহ্য

শিপ্ত বড়ুয়া

বুদ্ধ কীর্তন বাঙালির প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বুদ্ধ কীর্তন দেখতে হলে আপনাকে বৌদ্ধ পল্লীগুলোতে যেতে হবে। হঠাৎ নানান রকমের বিড়ির ধোঁয়া এসে লাগবে আপনার নাকে, ঘন ঘন সমাবেশের ভেতর থেকে বিড়ি জ্বালবে এবং সুখ টানে মগ্ন থাকবে গ্রামের বুড়ো-যুবকরা, মনেই হবে না কোন বুদ্ধ কীর্তনে বসে আছেন। ঝাঁঝালো গন্ধ আর হরেক রকম সুরের চিৎকার আর আপনি অস্থির হয়ে উঠবেন।

মূলত আদিমকালে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি মারা গেলে কিংবা মারা যাওয়ার কয়েকদিন পরে শ্রাদ্ধ বা সংঘদান অনুষ্টানের আগের রাতে গ্রামের সবাই মিলে বুদ্ধের জন্ম, মৃত্যু এবং জীবন নিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকজন কীর্তনীয়া গান, কথার সুরে গান করে থাকে। মাটিতে পাটি বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে। মাঝখানে থাকে বড় একটা জায়গা যেখানে কীর্তনীয়া বা কবিয়ালরা বসে পান-বিড়ি খেতে খেতে মাথায় বুদ্ধি জমাতে থাকেন।

বাংলা ঢোল, হারমোনিয়াম, ঝুরি (পিতলের দুই টুকরোর বাদ্যযন্ত্র), বাঁশি আর মিলে গেলে বেলা। এইসব নানান যন্ত্রপাতি থাকে একটি গ্রাম্য বুদ্ধ কীর্তনে। চারপাশ ধরে কীর্তনীয়াদের ঘিরে বসে গ্রামের যুবক, যুবতী, বুড়ো এবং অন্যান্য মানুষজন। সাধারণত কীর্তনীয়া যারা থাকেন তারা সেদিন ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়ে থাকেন। গ্রামের সাধারণ মানুষরাও লুঙ্গি-শাড়ী পড়েই কীর্তন দেখতে যান।

নম: নম: বুদ্ধ নম, বুদ্ধাং সারানাং গাচ্ছামি এসব কথাকে গানের সুরে তুলে কীর্তনীয়ারা মূলত কীর্তন শুরু করেন আর সাথে সাথে সুর মিলিয়ে অন্যান্য সকল মানুষরা সেসব কথার সাঁই জ্ঞাপক করেন সুরে সুরে। একটি গ্রাম্য বুদ্ধ কীর্তন অবশ্যই মাইক এর মাধ্যমেই করে থাকেন। সেখানে উন্নত কোন সাউন্ড সিস্টেম থাকে না।

আমার মনে হয় যদি মাইক না দিয়ে উন্নত সাউন্ড সিস্টেম দিয়ে বুদ্ধ কীর্তন করা হয় তাহলে বুদ্ধ কীর্তনের আসল রসবোধ হারিয়ে যাবে। যিনি হারমোনিয়ামে থাকেন ওনি মূলত মূল কীর্তনীয়ার গানের পর পর গান ধরে থাকেন এবং ওনার সাথে সাথেই সবাই গান করেন।

অসাধারণ বাংলা ঢোলের শব্দ আর বাঁশির সুরে আপনি কখনোই সাধারণ অবস্থায় বসে থাকতে পারবেন না, আপনার মনে হবে একটু তাদের সাথে গলা মিলিয়ে নিই আর একটু গা ঝাঁকা দিয়ে সুরে হারায়। তবে গলা মিলিয়ে নেওয়া এবং গা ঝাঁকানো আপনার পক্ষে একদম সহজ হবে কারণ কীর্তন যারা মন দিয়ে শুনবেন সবাই নিশ্চয় গান না ধরে এবং গা না ঝাঁকিয়ে বসে থাকতে পারবেন না সুতরাং তাদের সাথে এসব নির্দ্বিধায় মিলানো যায়।

একটি গ্রাম্য কীর্তনের মাধ্যমে আপনি মহামানব গৌতম বুদ্ধের জীবন, যৌবন এবং মৃত্যু পর্যন্ত সব ঘটনা খুব সহজেই জেনে যেতে পারেন। সংক্ষিপ্ত আকারে যেকোন একজন কীর্তনীয়া এসব বলতেই পারেন সচরাচর।

তাছাড়া যেটা অত্যান্ত মজার বিষয় সেটি হলো, যখন পালটা কীর্তন শুরু হয় তখন একজন একজন করে কীর্তনীয়া দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বুদ্ধের নানান কাহিনী নিয়ে গান করেন এবং প্রতিপক্ষ কীর্তনীয়াকে দু-তিনটে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি মাইকের স্পিকার প্রতিপক্ষের হাতে দিয়ে দেন এবং প্রতিপক্ষ কীর্তনীয়া সেই প্রশ্নের উত্তর নানান অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে ভাঙাতে ভাঙাতে উত্তর দেন।

আবার মাঝেমধ্যে আপনি লক্ষ্য করবেন অনেক প্রশ্নের উত্তর না জানার কারণে কীর্তনীয়ারা বইয়ের কথা টেনে আনেন এবং বলেন অনেক বই পড়েছি কোথাও পাইনি এই প্রশ্ন।

মাঝেমধ্যে দেখবেন কীর্তনীয়ারা অনেক কৌশলের মাধ্যমে তাদের কথা গানের মাধ্যমে সমাবেশকে বুঝিয়ে দেন। অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা এবং নতুন অনেক কিছু জানার আগ্রহ জন্ম নেবে একটি প্রকৃত বুদ্ধ কীর্তন দেখার মধ্য দিয়ে।

ভুলেও হাত বাড়াবেন না, যদি না আপনার সিগারেট অথবা বিড়ি খাওয়ার অভ্যাস থাকে। যে পরিবারের দ্বারা কীর্তন অনুষ্টানের আয়োজন করা হয় সে বাড়ি থেকেই সারারাত সমাবেশ জাগিয়ে রাখার ব্যাবস্থা হিসেবে লাল চা আর বিড়ি এবং পান সমাবেশের চারপাশে ঘুরে ঘুরে কেউ কেউ বিতরণ করবে।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে কীর্তন দেখা যেনো ফাইভ স্টার হোটেলে বসে কফি খাওয়াকেও হার মানাবে। যদি পেছনে হাত বাড়ান তাহলে হাতে বিড়িও ধরিয়ে দিতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি এক বিড়ি গাঁজা অথবা দু-চার প্যাক মদ খেয়ে কীর্তনে বসতে পারেন।

গাঁজা অথবা মদের নেশা আর গানের সুর আপনাকে আর কোনভাবেই বসে থাকতে দিবে না, কঠিন মনযোগ সৃষ্টি করে দিবে কীর্তনের কথার প্রতি এবং প্রচুর আনন্দ দিবে। তখন আপনার মনে হতেও পারে, আপনি স্বর্গ নামক রূপকথার দেশে গিয়ে সরাসরি গৌতমের মুখ থেকে নানান বাণী শুনছেন। সুতরাং কীর্তনে বসার আগে একটু-আধটু গাঁজা-মদ গিলে বসতেই পারেন।

একটি গ্রাম্য বুদ্ধ কীর্তন দেখতে ইচ্ছে হলে ভালো হয় যদি আপনার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোন বন্ধু থেকে থাকে অথবা আগেই থেকেই যদি ইচ্ছে পোষণ করে পরিচিত কাউকে বলে রাখেন।

বিশেষ করে যেসব বৌদ্ধপল্লী বাংলাদেশে রয়েছে তার মধ্যে কক্সবাজারের রামু, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, পটিয়াসহ রাউজান এসব জায়গায় বিভিন্ন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন, সেসব জায়গার পরিচিত মানুষজনকে বলে রাখলেই দেখতে পারেন ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধ কীর্তন।

আমি মনে করি বুদ্ধের যে কর্মবাদ তথা সাম্যবাদী বাণী তা সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছানোর সহজ মাধ্যম একটি গ্রাম্য বুদ্ধ কীর্তন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *