নীলোৎপল বড়ুয়া
“কোন প্রকার পাপকর্ম না করা, কুশল কর্ম সম্পাদন করা এবং আপন চিত্তকে নির্মল রাখা ইহাই বুদ্ধগণের অনুশাসন”। জেতবনে থাকার সময় আনন্দ স্থবিরের প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধের অনুশাসন অর্থাৎ বুদ্ধের ধর্ম কি এ বিষয়ে বুদ্ধ উপরোক্ত শ্লোকটির মাধ্যমে এক কথায় সহজতমভাবে প্রকাশ করেছেন।
বুদ্ধ যখন নিজ মুখে বুদ্ধের শিক্ষাকে অত্যন্ত সংক্ষেপে বলেন, “সমস্ত মন্দকর্ম (পাপ) পরিহার করা এবং সৎকর্ম (কুশল) সম্পাদনে ব্রতী হওয়া, আপন চিত্তের সংযম বজায় রাখা, এগুলিই বুদ্ধের শিক্ষা, (ধর্ম)” তখন স্পষ্টতই বুঝা যায়, বুদ্ধের ধর্ম কি।
এক্ষেত্রে একটা অনন্য ভাবনা ও সিদ্ধান্তের বিষয় তৈরী হয় যে বুদ্ধের ধর্ম অনুসরণ করতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী (প্রচলিত অর্থে ধর্মানুসারী বুঝাতে) হওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা অথবা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা প্রকৃত অর্থে বুদ্ধের ধর্ম অনুসরণ করে কিনা।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলী একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন, কি আস্তিক, কি নাস্তিক, স্বধর্মভ্রষ্ট না হয়েও অর্থাৎ পৃথিবীতে যে কেউ বুদ্ধের দীক্ষা গ্রহণ করতে পারে, বুদ্ধের শরণ নিতে পারে। তাহলে কি বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ারও দরকার নেই? পূজা-অর্চনা করারও দরকার নেই?
এবার প্রশ্ন হতে পারে বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করা বলতে কি বুঝায়। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধ বলেছেন- “যো চ বুদ্ধঞ্চ, সব্বদুকখা পমুচ্চতি (ধম্মপদ-১৯০, ১৯১, ১৯২) অর্থাৎ- “যদি কেউ বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের শরণ লয় এবং দুঃখ, দুঃখের উৎপত্তি ও দুঃখ মুক্তির উপায় আর্য অষ্টাংগিক মার্গ, এই চারটি আর্যসত্য, সম্যক জ্ঞানের সাথে দেখে তবে তাই হবে নিরাপদ আশ্রয়, উত্তম আশ্রয়।
এতে দুঃখ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না যে আর্য অষ্টাংগিক মার্গযুক্ত চতুরার্য্য সত্য ছাড়া বুদ্ধ-ধর্ম-সংঘ অর্থহীন। বুদ্ধের শরণ লওয়া মানে বুদ্ধ নির্দেশিত আর্য অষ্টাংগিক মার্গ পথে চলা। বুদ্ধের ধর্মের মূল হল এই চতুরার্য্য সত্য ও আর্য অষ্টাংগিক মার্গ।
বুদ্ধ মূলত সারাজীবন ধরে এই শিক্ষাই দিয়েছেন। সেই “ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র” থেকে শুরু করে সর্বশেষ “মহাপরিনির্বাণ সূত্র” পর্যন্ত সবকিছু এই চতুরার্য্য সত্য ও আর্য অষ্টাংগিক মার্গ নির্ভর। কুশল কর্ম সম্পাদন ও নিজ চিত্তকে নির্মল রাখার পথই হলো আর্য অষ্টাংগিক মার্গ।
ধম্মপদ’র আরেক জায়গায় বুদ্ধ বলেছেন – “বহুং বে সরণং, সব্বদুক্খা পমুচ্চতি” (ধম্মপদ ১৮৮, ১৮৯) অর্থাৎ “মনুষ্যগণ ভয় বিহŸল হয়ে পর্বত, বন, উদ্যানবৃক্ষ, চৈত্য ইত্যাদি বহু স্থানের শরণ নিয়ে থাকে। কিন্তু এ সকল নিরাপদ শরণ নহে, এ সকল উত্তম আশ্রয় নহে। এ সকল আশ্রয় গ্রহণ করলে দুঃখ হতে মুক্ত হওয়া যায় না”।
বুদ্ধের ধর্ম দুঃখ মুক্তির ধর্ম, আত্মমুক্তির ধর্ম। পাপ-পূণ্য বা স্বর্গ-নরকের ধর্ম নয়। অপরের কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে, মঙ্গল সাধনের উদ্দেশ্যে আত্মমুক্তির সাধনাই বুদ্ধের ধর্ম। মুক্তির পক্ষে আত্মশক্তিই প্রধান। কেউ কাউকে ত্রান্ করতে পারে না। ভক্তি বা শ্রদ্ধা নয়, আর্য অষ্টাংগিক মার্গ’ই হল মুক্তির পথ। বুদ্ধ ভক্তির কোন চরম আশ্রয়ের কথা বলেন নি।
কেউ কেবল নাম স্মরণে ও উচ্চরণেই মুক্তি পেতে পারে না। মানব গুরুকে দৈবশক্তি সম্পন্ন ত্রান্কর্তা বলে পূজা চর্চা করার বিরুদ্ধে বুদ্ধের ধর্ম। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’র কথাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ; বিশেষ স্থানে গিয়ে বিশেষ মন্ত্র পড়ে, বিশেষ অনুষ্ঠান করে মুক্তি লাভ করা যায় না। এই অত্যন্ত সহজ কথাটি বুদ্ধ আবিষ্কার করেছিলেন।
স্বার্থত্যাগ করে, সর্বভূতে দয়া বিস্তার করে, অন্তর থেকে বাসনাকে ক্ষয় করে ফেললেই তবে মুক্তি হয়। কোন স্থানে গেলে বা জলে স্নান করলে বা অগ্নিতে আহুতি দিলে বা মন্ত্র উচ্চারণ করলেও দুঃখ মুক্তি হয় না। এই নিতান্ত সরল কথাটির জন্য একজন রাজপুত্রকে রাজ্য ত্যাগ করে বনে বনে, পথে পথে, ঘুরতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আরো বলেন যে বুদ্ধের ধর্ম কেবলমাত্র জ্ঞানের ধর্ম, ধ্যানের ধর্ম নয়।
বুদ্ধ মানুষের আত্মশক্তির প্রচার করেছেন। তিনি দয়া এবং কল্যাণ স্বর্গের কাছে প্রার্থনা করেননি। মানুষের অন্তর হতে তিনি আহ্বান করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’র মতে “কর্ম নিরপেক্ষ জ্ঞানচর্চা নয়, আত্মপ্রত্যয়ের বীর্য ও জ্যোতিই বুদ্ধের ধর্মকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছিল। যেহেতু বুদ্ধের ধর্ম দুঃখমুক্তির ধর্ম, আত্মমুক্তির ধর্ম সেহেতু বুদ্ধ সর্বদা আত্মশক্তির উপরই নির্ভর করতে শিক্ষা দিয়েছেন।
মুক্তির পক্ষে আত্মশক্তিই প্রধান। মানুষের সামনে মানুষ হিসেবে দাঁড়িয়ে বুদ্ধই পৃথিবীতে প্রথম বললেন গুরু নয়, কোন দেবতা নয়, ভগবানও নয় কেবল স্বীয় কর্মের উপরই নির্ভর করতে হবে। বুদ্ধের ধর্ম অনুসারে নিজেই নিজের মুক্তিদাতা, নিজেই নিজের ত্রান্কর্তা, নিজেই নিজের প্রভূ”। বুদ্ধ বলেন – “অত্তা হি অত্তনো, লভতি দুল্লভং” (ধম্মপদ-১৬০) অর্থাৎ- আত্মাই আত্মার নাথ, অন্য নাথ আর কে হবে?
আত্মাকে সংযত করলে লোকে দুর্লভ নাথ লাভ করে। আরেক জায়গায় বুদ্ধ বলেন- “অত্তা হি অত্তনো, ভদ্রংব বাণিজ্য” (ধম্মপদ-৩৮০) অর্থাৎ- নিজেই নিজের প্রভূ। নিজেই নিজের গতি। বণিক যেমন সুন্দর অশ্বকে সংযত করে, সেরূপ নিজেকে সংযত কর। বুদ্ধ আরো বলেন “নসন্তি পুত্তা, ঞাতিসু তাণতা” (ধম্মপদ-২৮৮) অর্থাৎ- পিতা, পুত্র, বন্ধু, জ্ঞাতি কারও দ্ধারা ত্রান্ সম্ভব নয়।
বৌদ্ধ দর্শনের সারকথা, আত্মপ্রভাব দ্বারা ইন্দ্রিয় জয়; আত্ম-শক্তির বলে অন্তরকে হিংসা-দ্বেষ, কাম-ক্রোধ, লোভ-মোহ, মাৎসর্য ও জিঘাংসা মুক্ত করা। তাই আনন্দ স্থবিরকে উদ্দেশ্য করে “মহাপরিনির্বাণ সূত্রে” বুদ্ধের শেষ উপদেশ- “সুতরাং হে আনন্দ! নিজেই নিজের প্রদীপ হও।
নিজেই নিজের ধর্মশরণ শরণ লও। আত্মশরণ, অনন্যশরণ, ধর্মদীপ, অনন্যশরণ”। এখানে ধর্মের শরণ বলতে সত্য ধর্ম; চতুরার্য্য সত্য ও আর্যঅষ্টাংগিক মার্গ পথে চলার কথা বুঝানো হয়েছে প্রাথমিকভাবে। তারপর অন্যকিছু। এই প্রসঙ্গে একটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় বুদ্ধের আনুসারীদের মানে রাখা উচিৎ যে বুদ্ধের একান্ত সেবক হয়েও আনন্দ স্থবির বুদ্ধের জীবিত থাকা অবস্থায় অর্হৎফল লাভ করতে পারেননি।
এ বিষয়টি এই অর্থ বহন করে যে বুদ্ধ বা অন্য কোন ধর্মগুরু, মানবগুরু কাউকে মুক্তি দিতে বা ত্রান্ করতে পারে না। যদি পারা যেত তবে আনন্দ স্থবিরই প্রথম অর্হত্ব ফল লাভ করতেন।
“অঙ্গুত্তর নিকায়েও” বুদ্ধ বলেছেন, “ হে ভদ্দীয়, জনশ্রুতিতে বিশ্বাসী হইওনা। পরম্পরা গত প্রবাদেও নয়, জনরবেও বিশ্বাস করিও না। ন্যায় শাস্ত্রের সিদ্ধান্তেও নয়, বহিঃসাদৃশ্যেও আস্থা স্থাপন করিও না। যদি তুমি এই অন্তর্দৃষ্টি লাভ কর যে এই বস্তু দোষের, এই বস্তু দুর্ভাগ্যের এবং দুঃখের তবে তুমি তাহা পরিত্যাগ করিও”।
এমনকি বুদ্ধ বলেন- শিষ্যদেরও তথাগতকে পরীক্ষা করা উচিত যেন যে গুরুকে সে অনুসরণ করে তার সত্যিকার মূল্য ও যোগ্যতা বিষয়ে সে নিশ্চিত হতে পারে। তোমার পথে তোমাকেই চলতে হবে। বুদ্ধ কেবল সেই পথের নিশানা বলে দিতে পারেন।
বুদ্ধের ধর্ম অনুসারে বুদ্ধ কোন ত্রান্কর্তা নয়। তিনি কখনো দাবী করেন নি যে তিনি অবতার বা প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত। বুদ্ধ তাঁর সমস্ত অর্জন ও বোধ মনুষ্য প্রয়াসের উপর আরোপ করেছেন। একজন সাধারণ মানুষ চাইলে বুদ্ধ হতে পারে যদি সে ইচ্ছা করে এবং সেই প্রয়াস চালায়। প্রতিটি মানুষের মধ্যে বুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নিহিত আছে। আমরা বলতে পারি বুদ্ধ একজন পরমোৎকৃষ্ট ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত মানুষ।
তাঁকে যদি আমরা ত্রান্কর্তা হিসাবে অবিহিত করি এটা শুধু সে অর্থে যে, তিনি মুক্তির পথ, নির্বাণের পথ আবিষ্কার করেছেন যা পৃথিবীর নিয়মে চিরন্তন সত্য এবং আমাদেরকে দেখিয়েছেন। কিন্তু পথ চলতে হবে আমাদের নিজেদেরকে। বুদ্ধের শিক্ষা অনুসারে সত্যের বোধ এবং আত্মিক উন্নয়নের পথে “সন্দেহ” হল পাঁচটি অন্তরায় এর মধ্যে একটি। “সন্দেহ” কোন পাপ নয় কারণ বুদ্ধের ধর্মে “বিশ্বাস” বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। বস্তুত প্রচলিত ধর্ম মতে পাপ বলতে যা বুঝায় বুদ্ধের ধর্মে সেরকম কিছু নেই।
সমস্ত “মন্দ বা পাপ বা অশুভ” এর মূল হল “অবিদ্যা” (অজ্ঞতা) এবং ‘মিথ্যা দৃষ্টি’। এটা অনস্বীকার্য যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সন্দেহ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন অগ্রগতি সম্ভব নয়। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবে ও দেখতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত সন্দেহ থাকবে। সন্দেহ করা উচিৎ নয় বা বিশ্বাস করা উচিত এরকম কোন কথা থাকতে পারে না। শুধুমাত্র “আমি বিশ্বাস করি” বলা মানে এই নয় যে, “আমি বুঝেছি এবং দেখেছি”।
বুদ্ধের ধর্ম যেমন দুঃখ মুক্তির ধর্ম তেমনি তা কল্যাণ সাধনের ধর্ম। কল্যাণ সাধনের জন্য দরকার মৈত্রী সাধন। তবেই পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করবে। তাই আরেক প্রধান শিরোনামে বলা যায় বুদ্ধের ধর্ম শান্তির ধর্ম, মৈত্রীর ধর্ম। শান্তি ও মৈত্রীর ধর্ম হওয়া নির্ভর করে অপরের প্রতি মৈত্রী প্রদর্শনের উপর আর এর প্রধান ভিত্তি হলো সহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিকতা।
বুদ্ধের ধর্মে যেমন রয়েছে গণতন্ত্র ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা তেমনি তাঁর জীবন আচারেও রয়েছে সহিষ্ণুতার ও গণতান্ত্রিকতার চরম প্রদর্শনী। মহাপরিনির্বাণ সূত্রে তিনি আনন্দ স্থবিরকে বলেন যে তিনি কখনো সংঘকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা চিন্তা করেন নি এবং তিনি চান না সংঘ তাঁর উপর নির্ভর করুক। এমন কি মৃত্যুর কেবল পূর্ব মুহুর্তে পর্যন্ত তিনি শিষ্যদের কাছে জানতে চেয়েছেন তাঁর ধর্ম বিষয়ে তাদের আর কোন প্রশ্ন আছে কিনা।
এবং বলেছেন যদি তারা বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম বশতঃ জিজ্ঞাসা করতে না পারে তবে তাঁরা যেন অন্য কোন বন্ধু ভিক্ষুর মাধ্যমে জিজ্ঞাসা করে। সহিষ্ণুতার এক চরম উদাহরণ আমরা দেখি বুদ্ধের জীবনের আরেকটি ঘটনায়। নালন্দায় অবস্থানের সময় জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর তার উপালি নামের এক শিষ্যকে বুদ্ধের কাছে পাঠিয়েছিলেন কর্ম বিষয়ে বুদ্ধের মতকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করতে।
কারণ কর্ম বিষয়ে মহাবীরের মত ছিল ভিন্ন। আলোচনা শেষে উপালি যখন বুদ্ধের কাছে পরাস্ত হলো এবং বুদ্ধের যুক্তিতে তাঁর মধ্যে উপলদ্ধি জন্ম নিলো তখন সে বুদ্ধের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণের প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু বুদ্ধ তাকে পুনর্বিবেচনা করতে বলেছিলেন। উপালি যখন আবার প্রার্থনা জানালো বুদ্ধ তাকে বলেন সে যেন তাঁর আগের ধর্মীয় গুরুর প্রতিও একই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে চলে, আগে যেমন চলতো।
বুদ্ধ ধর্ম ও দর্শন সাধনার অন্যতম সোপান ‘ব্রহ্মবিহার’- মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা এই চার প্রকারের ভাবনা বা চর্চা। বুদ্ধ প্রতি দিনকার জীবন যাপনে কল্যাণময়, মৈত্রীময়, মুক্তির নিমিত্তে কর্ম সম্পাদন করতে বলেছেন। তাই বলা হয় কর্মেই ধর্ম।
ত্রিপিটকে যে সূত্রগুলো আছে এগুলো প্রায় সবই কথা প্রসঙ্গে অথবা কোন ঘটনা প্রসঙ্গে কারো না কারো সাথে বুদ্ধের আলোচনা ও উপদেশ। এসব সূত্রে বুদ্ধ যা উপদেশ দিয়েছেন, যা করতে বলেছেন তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে করতে হবে। শুধু সূত্রগুলো পাঠ করলে বা শ্রবণ করলে কোন লাভ নেই।
কল্যাণ, মৈত্রী, দুঃখমুক্তি কিছুই হবে না। যেমন মঙ্গল সূত্রে বুদ্ধ মানুষকে যা যা করতে বলেছেন তা না করে শুধু মঙ্গল সূত্র পাঠ করলে বা শ্রবণ করলে কোন মঙ্গল সাধন হবেনা, না সমাজের, না নিজের। বুদ্ধ নিজেই বলেছেন তাঁর ধর্ম বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য।
স্বার্থত্যাগ করে সকল জীবের প্রতি দয়া দেখানো, করুণা দেখানো, মৈত্রী দেখানোর উপদেশ বুদ্ধ বার বার দিয়েছেন। করণীয় মৈত্রী সূত্রে বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছেন- “মাতা যথা, অসপত্তং” অর্থাৎ- মা যেমন নিজের জীবন দিয়েও তার একমাত্র পুত্রের জীবন রক্ষা করেন সেরূপ সকল জীবের প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রী পোষণ করবে।
উর্ধ অধঃ চারিদিকে সমস্ত জগতের প্রতি বাধাহীন হিংসাহীন শত্রুতাশূণ্য অপ্রমেয় মৈত্রী পোষণ করবে। সকলে মৃত্যুকে ভয় করে। সকলকে নিজের ন্যায় ভেবে কাউকেও আঘাত করবেনা অথবা হত্যা করবেনা। ধর্মপদে গাঁথায় বুদ্ধ বলেছেন- “ক্রোধকে অক্রোধ দিয়ে জয় করবে, অসাধুকে সাধুতা দিয়ে জয় করবে, কৃপণকে দান দিয়ে জয় করবে, মিথ্যাবাদীকে সত্য দিয়ে জয় করবে” এবং “ইহ জগতে শত্রুতা দিয়ে শত্রুতা কখনো দমন করা যায় না।
উপরন্তু শত্রুশূন্যতা দিয়ে ইহা দমন করা যায়”। বুদ্ধ ধর্ম একান্তই প্রতিদিনকার জীবনের ব্যবহারিক ধর্ম, আচরণ সংশ্লিষ্ট ধর্ম। বুদ্ধের ধর্ম অনুশীলনের ধর্ম। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধের ধর্ম অনুসারে যে প্রার্থনা দিয়ে তাঁর “মানুষের ধর্ম” প্রবন্ধটি শেষ করেছেন তাই হওয়া উচিৎ আমাদের সকলের প্রার্থনা- “সকল জীব সুখী হোক, নিঃশত্রু হোক, অবধ্য হোক, সুখি হয়ে কালহরণ করুক।
সকল জীব দুঃখ হতে মুক্ত হোক, সকল জীব যথালব্ধ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হোক”। কিন্তু প্রার্থনা কার কাছে? বুদ্ধের ধর্ম অনুসারে প্রার্থনা কোন বহিঃশক্তির কাছে নয়। ইহা একপ্রকার চিত্ত উৎপাদন করা। মনে মনে একটি ইচ্ছা উৎপন্ন করানো, যাতে পরবর্তীতে সেই ইচ্ছা অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করা যায়। বুদ্ধের ধর্ম বিশ্লেষণে বুঝা যায় মনের উৎপত্তি ব্যাতীত দেহ কোন কিছু ধারণ করতে পারে না।
দেহ কার্য দ্বারা যা কিছু প্রকাশ করে তার উৎপত্তি মনেই। তাই বুদ্ধ ধম্মপদ’র প্রথম শ্লোকে বলেছেন মনই ধর্ম সমূহের পূর্বগামী, মনই প্রধান ধর্ম, ধর্ম মন হতে উৎপন্ন হয়। এখানে ধর্মকে সরল অর্থে অচরণ বা কর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। মানুষের স্বভাব বা চিন্তা মনের দ্বারাই অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত হয়। আবার মনে উৎপন্ন চিন্তা যদি দেহ ধারণ না করে, কার্য দ্বারা প্রদর্শিত না হয় তবে তার কোন ফল বা সার্থকতা নাই।
তাই ধম্মপদ’র ২৫৯ শ্লোকে বুদ্ধ স্পষ্ট করে বলেছেন, যদি কেউ বহু বাক্য বলে তবে তা দ্বারা সে ধর্মধার হয় না। কিন্তু যিনি অল্পমাত্র ধর্ম শুনে তা দেহ দ্বারা দর্শন করেন তিনিই ধর্মধার। অতএব প্রার্থনা যদি শুধু মুখের উচ্চারণ হয়, তা কখনই বুদ্ধের ধর্ম নয়। প্রার্থনাকে কর্মের দ্বারা দৃশ্যমান করতে হবে। তবেই এরূপ প্রার্থনাকারীকে ধার্মিক বলা যাবে। কারণ বুদ্ধের ধর্ম দৃশ্যমান।
বুদ্ধ মঙ্গল সাধনা দ্বারা প্রেমকে বিশ্ব চরাচরে মুক্ত করতে উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর মুক্তির সাধনাই ছিল স্বার্থত্যাগ, অহংকার ত্যাগ-ক্রোধত্যাগের সাধনা, ক্ষমার সাধনা, দয়ার সাধনা, মৈত্রীর সাধনা, প্রেমের সাধনা। এই সাধনার মধ্য দিয়েই অহং নির্বাপিত করে দিলেই তবে মুক্তি। তাইতো প্রয়োজন বোধিসত্ত্ব জীবন-যাপন যা বৌদ্ধ সাহিত্যের বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখিত আছে।
বুদ্ধের ধর্মে চূড়ান্ত লক্ষ্য হল নির্বাণ। কিন্তু নির্বাণ সম্বন্ধে বুদ্ধের প্রচার যৎসামান্য। কারণ তিনি বারবার শিষ্যদের জানিয়েছেন যে, সাধন মার্গের চরমে না পৌঁছালে নির্বাণ যে কি তা হৃদয়াঙ্গম করা যায় না। যারা সাধনার নিচের স্তরে আছেন তাদের নির্বাণ সম্পর্কে যতই কিছু বলা হোক না কেন তার কোন ফল হবে না।
নির্বাণ সম্পর্কে রাজা মিলিন্দকে ধারণা দিতে গিয়ে নাগসেন বলেন যে, রুদ্ধ হওয়াই নির্বাণ। অজ্ঞানী বিষয় উপভোগে লিপ্ত থাকে এবং তা থেকে আনন্দ গ্রহণ করে ও তাতেই মগ্ন থাকে। আসক্তিতে লিপ্ত অজ্ঞানী এই ধারার মধ্যেই অবস্থান করে এবং বারবার জন্ম গ্রহণ করে, বৃদ্ধ হয়, মৃত্যুবরণ করে, শোক ভোগ করে, অশ্রুপাত করে। দুঃখ, কষ্ট, পরিশ্রান্তি কখনোই তাকে ত্যাগ করে না।
সে দুঃখ থেকে ততোধিক দুঃখে পতিত থাকে। জ্ঞানী ব্যক্তি কিন্তু বিষয় ভোগে লিপ্ত থাকে না। ফলে তার তৃষ্ণা রুদ্ধ হয়ে যায়। উপাদান (ভোগ) রুদ্ধ হয়ে গেলে গমনাগমনও রুদ্ধ হয়ে যায়। এরপর বার্ধক্যে পৌঁছানো, মৃত্যু ইত্যাদি সমস্ত দুঃখ রুদ্ধ হয়ে যায়। এই রুদ্ধ হয়ে যাওয়াই নির্বাণ।
নির্বাণ কোন দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান স্থান নয়। এটি একটি অবস্থা মাত্র। বুদ্ধ নির্দেশিত আর্যঅষ্টাংগিক মার্গ পথে যথা-যথভাবে জীবন যাপন যে করবে, জীবনকে সতর্ক মনযোগের মাধ্যেমে সৎ ইচ্ছা দ্বারা শৃংঙ্খলিত যে করবে সেই বুঝতে পারবে নির্বাণ কি। এটি সর্ম্পূণ উপলব্ধির বিষয়।
প্রায় একটা প্রশ্ন করা হয় যে, বুদ্ধের ধর্ম কি প্রচলিত অর্থে ধর্ম নাকি দর্শন? নাম যাই হোক সত্য সত্যই। সত্যকে যে নামেই নামাঙ্কিত করা হোক না কেন তা সত্য হিসাবেই বিরাজ করবে। গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন গোলাপ একই মিষ্টি গন্ধ ছড়াবে সবসময়। রাহুল সাংকৃত্যায়ন এর মত অনুসারে বুদ্ধের উপদেশাবলীকে বুঝার সুবিধার্থে বুদ্ধের মূল চার সিদ্ধান্ত আমাদের পূর্বেই জানা দরকার।
এর মধ্যে তিনটি অস্বীকারাত্মক এবং একটি স্বীকারত্মক। এই চার সিদ্ধান্ত হলো- (১) ঈশ্বরকে অস্বীকার করা; অন্যথায় মানুষ স্বয়ং নিজের প্রভু- এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হয়। (২) আত্মার নিত্যতাকে স্বীকার না করা; অন্যথায় তার পরিশুদ্ধি বা মুক্তির কোর প্রশ্নই উঠে না। (৩) কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে স্বীকার না করা; অন্যথায় বুদ্ধিবৃত্তি এবং অভিজ্ঞতা মূল্যহীন না হয়ে, শুধু এক আকস্মিক ঘটনারূপে প্রতিভাত হবে। বুদ্ধের শিক্ষা (ধর্ম) এবং দর্শন এই চার সিদ্ধান্তের অবলম্বনের উপর দন্ডায়মান।
চারটি সিদ্ধান্তের প্রথম তিনটি, বড় পরতন্ত্রতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে। চতুর্থটি আশাপ্রদ ভবিষ্যতের চিত্র আঁকে এবং শীল সদাচারের ভিত প্রতিষ্ঠা করে। এই চার সিদ্ধান্ত যেখানে সম্মিলিত হয় সেটাই বুদ্ধের ধর্ম।
সহায়ক গ্রস্থপঞ্জী :
- বৌদ্ধ দর্শন , রাহুল সাংকৃত্যায়ন
- বুদ্ধদেব , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বৌদ্ধ ধর্ম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , ড. আশা দাশ
- ধম্মপদ , সম্পাদনা: চারুচন্দ্র বসু
- মানুষের ধর্ম , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- ধূপছায়া , সৈয়দ মুুজতবা আলী
- সদ্ধর্মনীতি রত্নমালা , শ্রী সুভুতি রঞ্জন বড়ুয়া
- মহাপরিনির্বাণ সুত্তং , রাজগুরু শ্রী ধর্মরত্ন মহাস্থবির