পৃথিবী নিঃশ্চয় স্থির, এর কোন নড়চড় নেই

রাজিক হাসান

– বাইবেল (Psalms 104:5)

বাইবেলের এই মতাদর্শের শিকলে হাজার বছরের উপর আবদ্ধ ছিল মানুষের জ্ঞান। বাইবেলের ওই স্তবকটিই ব্যবহার করা হয়েছিল প্রমাণ হিসাবে, জোতির্বিদ গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে। গ্যালিলিও, জ্যোতির্বিদ কোপার্নিকাসের দেওয়া মতবাদের পক্ষে কথা বলেছিলেন – “পৃথিবী স্থির নয় সূর্যের চারপাশে ঘুরছে।”

কোপার্নিকাসের মতবাদটির পক্ষে বলার জন্য ১৬৩৩ সালে রোমে তলব করা হয় ৭০ বছরের বুড়ো গ্যালিলিওকে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ “প্রচলিত ধর্মীয় মতবাদের বিরুদ্ধ বিশ্বাস” এর অপরাধ। তারপর বুড়ো গ্যালিলিওকে নিয়ে যাওয়া হয় চার্চের পীড়ন কক্ষে, দেখানো হয় যন্ত্রণা দেওয়ার সরঞ্জাম ও তার পদ্ধতি। গ্যালিলিওকে বলা হয় যদি সে তাঁর মতবাদ পরিত্যাগ না করে, তাঁকেও পেতে হবে অমানুষিক যন্ত্রণা।

পীড়ন আর জর্দানো ব্রুনোর দূর্ভাগ্যের কথা স্মরণ করে গ্যালিলিও ভয় পেয়ে যান, কারণ একই অপরাধে কয়েক দশক ( ফেব্রুয়ারি ১৯, ১৬০০) আগে স্বাধীন চিন্তার দার্শনিকটি রোমের রাস্তায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় অগ্নিমঞ্চের দিকে, তারপর নগ্ন করে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। এরপর গ্যালিলিওকে গৃহবন্দী করা হয়, বন্ধকরে দেওয়া হয় সবার সঙ্গে যোগাযোগ। এভাবেই কেটে যায় তাঁর জীবনের শেষ সাতটি বছর।

“মহাবিশ্বে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরছে – এই মতবাদ অবশ্যই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর কেননা এই মতবাদ আমাদের পবিত্র গ্রন্থের পরিপন্থী, এবং সেই কারণেই এই মতবাদ আমাদের পবিত্র বিশ্বাসকে আঘাত করেছে।”

” বিশ্বাসের স্বাধীনতা সবসময় ক্ষতিকর কারণ এটা ভুল হওয়ার স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

– রবার্ট বেল্লার্মিন, কার্ডিনাল অব রোমান ক্যাথলিক চার্চ

“গ্যালিলিওর মতবাদটি ভ্রান্ত ; ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক দুই ভাবেই, এবং অবশ্যই ভুল আমাদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে। ”

– তৎকালীন চার্চের ঘোষণা

“সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী ঘুরে – এই ধারণা শুধু ভ্রান্তই নয়, পবিত্র যিশু কুমারী মেরীর গর্ভে জন্মনেয়নি তার মত এক ভয়ঙ্কর ধারণা। ”

– কার্ডিনাল বেল্লার্মিনে, ট্রায়ালের সময় (১৬১৫)

“দুই হাজার বছরে এক গ্যালিলিওই যথেষ্ঠ প্রচলিত বিশ্বাস ধ্বংস করতে।”

– পোপ পিউস (দ্বাদশ)

গ্যালিলিও পীড়ন ও হত্যার ভয়ের তাঁর মতবাদ (জুন ২২, ১৬৩৩) পরিত্যাগ করে।

১৮৩২ সাল পর্যন্ত গ্যালিলিওর সকল মতবাদ ও বই ক্যাথলিক চার্চ নিষিদ্ধ করে রাখে। তাঁর ট্রায়ালের দুই শত বছর পর আইজ্যাক নিউটন সত্যটি প্রতিষ্ঠিত করে।

১৯৯২ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হন, গ্যালিলিওকে নির্যাতন করার কারণে, তিনি এও স্বীকার করতে করতে বাধ্য হন যে , শুরুতে ক্যাথলিক চার্চের ভুল ছিল এবং গ্যালিলিও ছিল সঠিক।

১৫০০ বছর ধরে ক্যাথলিক চার্চ প্রচার করে আসছিল বাইবেলের প্রতিটি শব্দ সত্য – ঈশ্বরের অমোঘ বাণী। কিন্তু তারা অবশ্যই ভুল ছিল, যারা তাদের মতবাদের বিরুদ্ধাচারণ করেছিল তাদের ভাগ্যে নেমে এসেছিল নারকীয় নির্যাতন, এমন কী মর্মান্তিক মৃত্যু।

ভারতীয় পৌরানিক কাহিনীতে পাওয়া যায়; সমুদ্রমন্থনে উঠে আসা অমৃত নিয়ে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে  ঝগড়া বাঁধে। ঝগড়ার সুযোগে রাহু (স্বরভানু) নামক এক অসুর লুকিয়ে দিব্য অমৃতের কয়েক ফোঁটা পান করে ফেলে। সূর্য্য ও চন্দ্রদেব তাকে চিনতে পেরে মোহিনী অবতাররূপী ভগবান বিষ্ণুকে জানায়। তৎক্ষণাৎ,অমৃত গলাধঃকরণের পূর্বেই বিষ্ণু আপন সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে রাহুর ধড় থেকে মুন্ড ছিন্ন করে দেন। অমৃত পানের জন্য মুন্ডটি অমরত্ব লাভ করে এবং এভাবেই রাহু গ্রহটির উৎপত্তি হয়; বাকী মুন্ডহীন দেহটির নাম হয় কেতু। এরা দুটি অশুভ গ্রহ বলে হিন্দুশাস্ত্রে কথিত। সূর্য্য ও চন্দ্রের প্রতি বিদ্বেষের কারণে বছরের নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাহু এদেরকে গ্রাস (গ্রহণ) করে ফেলে। আর সেই কারণেই সূর্যগ্রহণ এর সময় মানবকল্যাণ ও সুর্যদেবের আশুমুক্তির জন্য আর্যরা হুলুধ্বনি, ঘন্টা ও কাঁসর বাদন, গঙ্গাস্নান ও কুম্ভমেলার আয়োজন করে।

প্রাচীন মিশরীয় পৌরাণিকে পাওয়া যায়  – আকাশ যখন নীলবর্ণ, তখন অবশ্যই আকাশ একটি নদী বা সমুদ্র। কিন্তু ওই নীল সাগরে সুর্যদেব চলে কি প্রকারে, অত বড় সমুদ্রতো আর প্রতিদিন সাঁতরিয়ে পার হওয়া সম্ভব নয়, নিশ্চয় সুর্যদেব রোজ রোজ নৌকায় ভ্রমণ করে।

গ্রীক দেবতা এপোলো , সাত ঘোড়ায় টানা রথে পূর্ব থেকে পশ্চিমে আকাশা পাড়ী দিতেন। গ্রীক মিলাথোলজির সাথে হিন্দু পুরাণের বেশ মিল। হিন্দু পুরাণেও রথে টানা সাত ঘোড়ার কাহিনী পাওয়া যায়। সমরেশ বসুর “পৃথা” গ্রন্থে এ নিয়ে অনেক বিস্তারিত যুক্তিনির্ভর আলোচনা রয়েছে। আগ্রহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন।

বহুল পঠিত বাইবেল গ্রন্থ থেকে পায় যায় সূর্যের বাহন নৌকা, চতুর্থ আসমানে একখানা সোনার নৌকায় সূর্যকে রেখে ৭০ হাজার দেবদূত সূর্য সহ নৌকাটিকে টানিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে টেনে নিয়ে যায়। সারারাত সূর্য আরশের নিচে বসে ঈশ্বরের বন্দনা করে এবং সূর্য  ওঠার একুট আগে আবার পূর্বদিকে হাজির হয়। যে কারণে চন্দ্র গ্রহনে ইহুদিরা বিশেষ প্রার্থনা করে। মুসলমানেরা চন্দ্রগ্রহণের সময় কূছুফ ও সুর্য গ্রহনে খুছুফ সুন্নাৎ নামাজ আদায় করে।

পুরানো ধারণা ও ধর্মীয় মতবাদের মূলে ছিল অলীক কল্পনা আর অন্ধবিশ্বাস। এই অন্ধবিশ্বাসের মূলে প্রথম আঘাত করে পিথাগোরাস নামক এক গণিতজ্ঞ প্রায় ২৫০০ বৎসর আগে। আর আজ থেকে ৪০০ বছর আগে পুরানো ভ্রান্ত মতবাদের অবসান করে বহুল খাঁটি সত্যের প্রতিষ্ঠিত করে রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কোপার্নিকাস।

তার ১০০ বৎসর পর গ্যালিলিও দূরবীন যন্ত্রের আবিস্কার করলে জ্যোতিষ্কলোকের জটিল রহস্যের সমাধানের দ্বার খুলে যায়। গতকাল শনিবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে মফ্রেঞ্চ গায়ানাতে অবস্থিত ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ)’র লঞ্চপ্যাড থেকে জেডব্লিউএসটি যাত্রা শুরু করেছে মহাকাশের পথে।  জেমস ওয়েব পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্পেস টেলিস্কোপ। এক হাজার কোটি ডলার খরচ করে নির্মিত ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি)’-কে বিবেচনা করা হচ্ছে একুশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিশ্রুতিশীল বৈজ্ঞানিক প্রকল্পগুলোর একটি হিসেবে।

একবিংশ শতাব্দীর মহাবিস্ময়, স্মরণকালের সর্ববৃহৎ এই নভোদুরবিনটির ওজন ৬ হাজার ১৬১ কেজি এবং এতে সোনার খুবই পাতলা প্রলেপ দেয়া মোট ১৮টি ষড়ভুজ আয়না রয়েছে। সবগুলো আয়না মিলিয়ে ব্যাস ৬.৫ মিটারের খানিকটা বেশি। টেলিস্কোপটি নির্মাণ করতে ৩০ বছর ধরে ৪ কোটি ঘন্টা পরিশ্রম করতে হয়েছে বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদদের। খরচ পড়েছে ১০০০ কোটি ডলারেরও বেশি।

অত্যান্ত সংবেদনশীল এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময়কর উৎকর্ষের এ টেলিস্কোপটি আসলেই একটি টাইম মিশন। ১ হাজার ৩৭০ কোটি বছর আগের বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির সময়কার প্রথম আলো বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে অর্থাৎ হাজার কোটি বছর আগের অতীতকে দেখতে পাবো আমরা। সেই সাথে আমাদেরকে খবর দেবে মহাকাশের নিযুত কোটি  গ্রহ, উপগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা, তার। উম্মোচিত হবে সৃষ্টি রহস্য।

মহাকাশে বিজ্ঞানের এই মহা আয়োজন ঈশ্বরের সন্ধানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *