জাগরণের নায়ক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

মনির ইউসুফ

প্রাচীন যুগ থেকে আমরা সপ্তসিন্দুর এ ভূখণ্ড, ভারতের ইতিহাস যদি একটু তলিয়ে দেখি; তাহলে দেখবো- সেখানে ভারতের বর্তমান ভুল ও ফুলের অনুরাগে প্রস্ফুটিত হয়ে আছে। আরও দেখবো ভারতীয় হিন্দু মুসলমান ভারতের ইতিহাসের কোন কাজে লাগেনি, তারা বরং ইতিহাস তাদের কাজে লাগিয়ে ইতিহাসের ঐতিহাসিক সত্যকে ধ্বংস করেছে। এখন আমাদের কাজ হবে সেই ধ্বংসের ছাইভষ্ম থেকে ইতিহাসকে বের করে আনা। এই অন্বেষণ খুব যে সহজ এমন নয়।

তবুও, ইতিহাস জানাটা ঐতিহাসিকভাবে আমাদের জন্য অপরিহার্য। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস আমাদের যেমন জানতে হবে, তেমনি করে আর্য-অনার্যের সঙ্গে কিলাত, নিষাদ, পণি, ইতিহাসের ভাষায় অসুরসহ নানা গণদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে যতটুকু পারা যায় তার সবটুকু জানতে হবে।

সপ্তসিন্ধুর স্বরসতী, রাবী, সতলজ, বিপাশা, বিতিস্তা ও সিন্ধুর তীরে বসতি গড়ে তুলেছিল যাযাবর আর্যজন। পৃথিবীর জনগুলোর মধ্যে সপ্তসিন্ধুর তীরে অনেকগুলো জাতিগোষ্ঠী বসবাস করতো, সেসব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আর্যজন’রা প্রায় যুদ্ধে জড়িয়েছে, তাদের পশু, শিশু,নারী, ভূমি দখল করে আর্যজন নিজেরা সেখানে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

তারপর কত ভাঙাগড়া, কত জনশ্রুতি, যুদ্ধ, রক্ত, দাসত্ব, রাজত্ব, মহাভারত সেই ইতিহাসের ‘ই’ ও আমরা জানি না। ভারতের ভূমি সন্তান অনার্য বলি, আর্যজন বলি, হাজার হাজার বছরের পথপরিক্রমায় মিশে গেছে রক্তে-চামড়ায়, মনে-মগজে, সামাজিক-রাষ্ট্রীয়, সাম্রাজ্যিক, নাগরিক ভাবনায়। এভাবে রক্তঘ্রাণে, রক্তস্বেদে পৃথিবীর সব মহাদেশে সব দেশের মানুষের পরিব্রাজন হয়েছে।

সুতরাং ভারত ও তার বাইরে নয়। যদি এমন হত ভারত এই গ্রহের বাইরের কোন ভূখণ্ড, তাহলে তা মেনে নেওয়া যেত, কিছু ভিন্ন ধর্মের মানুষ ভারতের সন্তান নয় বলে যারা এখনও চিল্লাপাল্লা করছেন তারা সত্যকে উল্টে দিতে চাই। কাহিনি কিংবদন্তি নয়, ইতিহাসের মৌলিক বিধির উপর আমাদের জোর দিতে হবে। ভারত হোক, বার্মা হোক বলতে পারি- পৃথিবীর জাতীয়তাবাদের ইতিহাস ও তাই।

আর্যরা হঠাৎ এসে ভারত ভূমির মালিক হয় নাই বা তাদের ভাষায় স্বদেশ করে নাই। এজন্য তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। যুদ্ধে জয়ী হয়ে তারা এদেশের অধিকারী হয়েছে, এখানে তাদের বসবাস করতে হয়েছে। শঙ্কা, আশঙ্কা, লড়াই, যূদ্ধ, জীবন ক্ষয় ইত্যাদি- তাদের ও কম স্বীকার হতে হয় নাই।

কত স্বপ্ল ইতিহাস জ্ঞান নিয়ে- আমরা মন্তব্য করি ইতিহাসের। কত অজ্ঞান নিয়ে আমরা জাতিতত্ত্বের জ্ঞান বিলাই। ভারতবর্ষের ইতিহাস বহুজাতির ইতিহাস। এ কথা আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ ক্রম প্রসারিত ভারত ভূমি, তার বহু জনজাতির শ্রমে ঘামে রক্তে নারীর পিত ও নাড়ীর বেদনায় সিক্ত। যারা এই মন মাটি জনগোষ্ঠীর আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে তারা সবাই এর সন্তান।

প্রাচীন যুগ পার হয়ে মধ্যযুগ গণ থেকে ধর্মীয় পরিচয় বড় হতে থাকে, মধ্যযুগের প্রায় তেরশো বছর; নতুন ধর্মীয় জাতি মুসলমান জনগোষ্ঠীর বলা যায়। তখন ভারতে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের সংঘর্ষ চলছে। কোথাও আর্য ধর্ম হিসেবে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার, কোথায় আর্য সনাতন ধর্ম হিসেবে হিন্দু ধর্মের টিকে থাকা নিয়ে তুমুল যুদ্ধ।

নতুন ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম তখন মানুষের আবেগে ঠাঁই করে নিয়েছে। ঢিমে তালে হিন্দু ধর্মও টিকেছিল। রাজশক্তির সহায়তায় মধ্যযুগে আবার হিন্দু ধর্ম প্রবল প্রতাপে ফিরে আসে। জনপদে জনপদে হিন্দুধর্মের প্রসার বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে হিংস্রতাও। সেই সময় আরবের যাযাবর ভূমিতে ইসলাম নামে যে ধর্মটি প্রসার লাভ করে সেটি পারস্য হয়ে গান্ধারে প্রচারিত হতে থাকে। জৈন ধর্মসহ ভারতের দুই বড় ধর্ম হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর গরীব অসহায় উপগোষ্ঠীদের অনেকে (উপজাতি) এ ধর্ম গ্রহণ করেন। কাহিনির এসব আমরা জানি, কিন্তু ইতিহাস জানি না।

তারপর ইসলাম ধর্ম ক্রম প্রসারিত ও স্থায়ী হয়। ভারতের মুসলিমরাও যে ভারতের সন্তান সে কথা যেসব হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ এখন ও মেনে নিতে পারেন নাই তাদেরকে ইতিহাসের এদিকে গভীরভাবে নজর দিতে বলবো। মুসলমানদের ও এ বিষয়টি ভাবতে হবে।

আরব থেকে এখানে যারা এসেছিল তারা শুধু ভারতের মুসলমান না, এই ভারতের লক্ষকোটি মাটির সন্তান মুসলমান হয়েছে। সেই শত শত বছরে ভাঙাগড়ায় ভারতে হিন্দু-মুসলমান তাদের সংস্কৃতি, তাদের সভ্যতাকে নির্মাণ করেন। মুসলমান শাসনে- সভ্যতার যাত্রা পথে হিন্দুদের বিদ্বেষ যেমন জমা হয়েছে, তেমনি জমা হয়েছে মুসলমানদের অহংকারও।

হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও প্যারালালভাবে জাগতে শুরু করলো। ইতিহাসে এখানে আমরা বঙ্কিমচন্দ্রকে পাশ নাম্বার দিতে পারি, যে নিজ জাতি সম্প্রদায়কে জাগাতে গিয়ে, অচেতনে আর একটি জাতি ও জাগিয়ে দিলো। যে জাতির প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হলো, সে একই বিদ্বেষ নিয়ে ঐ জাতি ও জেগে উঠলো। বিদ্বেষ বিদ্বেষকে বাড়ালো।

দেশ ভাগের পর সে বিদ্বেষের রোষ, ক্রোধ, ঘৃণা, হিংস্রতা, লোভ, লালসা, রক্ত, লাশ হয়ে ভারতের ফুলের অনুরাগে হুল ফুটালো। আহা, এক প্রতিবেশি আরেক প্রতিবেশির কাছে নিমিষেই অপরিচিত হয়ে গেল। ভারতের ইতিহাসে এমন কলঙ্কজনক ঘটনা আর ঘটেনি।

বঙ্কিমচন্দ্র চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (আনন্দ মঠ- ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দ), (সীতারাম ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দ) ভারতীয় স্বারস্বত সমাজের মধ্যে যে রাজনৈতিক আলোড়ন তুলেছিল, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ভারতীয় মুসলমানদের বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি হাজারো অভিযোগ সত্ত্বেও, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দু ও মুসলিম দুই জাতি সম্প্রদায়কে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। এ সত্যটি হিন্দুদের তো কেউ বুঝেনি, মুসলমানদের ও কেউ এ যাবৎ এটি ধরতে পারে নাই। এটা ঘটেছে নিরবে, অজ্ঞানে। মুসলমানদের ভারত শাসন করার কারণে।

ভারতের দেশভাগ হুট করে হয় নাই, তার আগে ভারতের বৃহৎ দুই জাতির মন ভাঙা শুরু হয়। সেই মন ভাঙার সাহিত্যিক ও রাজনৈতক গুরুর নেতৃত্ব দেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই পর্ব শুরু হয় ‘আনন্দ মঠ’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার আগে কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে  বঙ্কিমচন্দ্র কি ভারতীয় মনকে জাগিয়ে দেননি? ‘কপাল কুণ্ডলা’ উপন্যাসে বঙ্কিম ব্যক্তিকে জাগিয়ে দিচ্ছেন, প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছেন। ‘তুমি অধম বলে আমি উত্তম হব না কেন? পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো? এসব সংলাপগুলো ভারতীয় নাগরিক মনে চেতনা ও বোধ তৈরি করে দিয়েছে। শতাব্দীকে গ্রাস করা এই সংলাপগুলো ভারতীয় মনে যে চেতনা তৈরি করেছে, সে চেতনার নবারুণ হলো,

ভারতীয় হিন্দু মুসলমানের চেতনার আলো। সে চেতনা সাম্প্রদায়িক হলে ও আখেরে দুই জাতি সম্প্রদায়কে সচেতন করেছে। ভারতবর্ষ যদি রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হতো, তাহলে এর ইতিহাস হতো ভিন্ন।

ভারতের স্বাধীনতা দেশভাগের কলঙ্ক কোন জাতি সম্প্রদায়কে বহন করতে হত না। হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ভারতীয় ইতিহাসের এ কালে এসে যদি একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে তাহলে ইতিহাস-ইতিহাস বলে কি লাভ। সে ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে ভারত কি শিখেছে? বিদ্বেষ বাদ দিয়ে দুটি জাতির জাগরণের নায়ক হিসেবে বঙ্কিমের প্রতি আমার ভালোবাসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *