লেলিনের মতে গ্রন্থাগার হবে শিশু-কিশোর, শ্রমজীবী রুশীয় এবং অ-রুশীয় প্রত্যেকের। গ্রন্থাগার একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। তাই প্রত্যেকের থাকবে সমান অধিকার। কিন্তু মানতে হবে গ্রন্থাগারের নিয়ম-কানুন। লেনিন নিজেও মানতেন গ্রন্থাগারের নিয়ম-কানুন।
তিনি যে কতটা নিয়মনিষ্ট ছিলেন তাঁর পরিচয় ফুটে ওঠে রুমিয়ানৎসেভ মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে লেখা তাঁর এক পত্র থেকে। সেই সময় তাঁর কিছু অভিধানের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নানা কাজের চাপে দিনের বেলায় তাঁর গ্রন্থাগারে যাওয়া সম্ভব ছিল না। রাত্রে সময় পেলেও গ্রন্থাগার রাতে বন্ধ থাকে আবার দিনের বেলায় অভিধানগুলো বের করে রাতে যে পড়বেন তারও উপায় ছিল না।
কারণ অভিধান গ্রন্থ আর সাধারণ গ্রন্থ এক নয়। অভিধান গ্রন্থ পাঠকের এত কাজে লাগে যে তা কোনো ব্যক্তিকেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধার দেওয়া হয় না। এগুলো শুধুমাত্র রেফারেন্স হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। অথচ লেনিনের দরকার একটা ভাল জার্মান ভাষার অভিধান ও দর্শনের অভিধান।
১৯২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি ওই গ্রন্থাগারের গ্রন্থগারিকের উদ্দেশ্যে তাই লিখেছিলেন- যদি নিয়ম অনুযায়ী রেফারেন্স বই বাড়িতে নিয়ে না যাওয়া যায় তবে কি গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে যাবার পর এক রাতের জন্য বা সন্ধ্যার দিকে বইগুলো পড়তে দেয়া যায় না। সকালের মধ্যেই তা আমি ফেরত দিয়ে দেব। শেষ লাইনটা মোটা হরফে লেখা হয়েছিল)।
বইগুলো অবশ্য কথামতো তিনি সকালেই ফেরত দিয়ে দেন। কিন্তু চিঠিটির কথা উল্লেখ করতে হল এই কারণেই যে এখনও আমরা দেখতে পাই বহু বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত, ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাড়িতে বই নিয়ে যান কিন্তু সময়মতো ফেরত দিতে ভুলে যান। লেনিন, একাধারে বিপ্লবী, দার্শনিক ও রাষ্টনায়ক, একবিংশ শতকেও যিনি অমর ও উজ্জল হয়ে আছেন শ্রমজীবী মানুষের মাঝে, শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি কিন্তু নিয়মনিষ্ট ছিলেন।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত গ্রন্থাগারেরও রয়েছে একটি সামাজিক চরিত্র। এই সামাজিক চরিত্র নির্ধারণে তিনি গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থসম্ভার শুধু মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য নয় তা সমাজের সকলের জন্য এই বক্তব্যকে তিনি শুধু আপ্ত বাক্য হিসাবে ব্যবহার করেননি বরং যতক্ষণ পর্যন্ত না সকলের জন্য গ্রন্থের ব্যবস্থা করা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত যাবতীয় সম্ভাব্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে লড়াই চালানো প্রয়োজন গ্রন্থাগারের গণতন্ত্র বলতে লেনিন সেই কথাই বোঝাতে চাইতেন।
গ্রন্থসম্ভার ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থার সুফল পৌঁছে যাক সকলের কাছে গণতান্ত্রিক নিয়মেই। কারণ গ্রন্থাগারের সামাজিক চরিত্রই হল আরো বেশি পাঠক সৃষ্টি করা, গ্রন্থাগার পরিষেবার মান বৃদ্ধি করা ও মানবিক সম্পদের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করা। কারণ গ্রন্থাগার তথাকথিত কিছু শিক্ষিতজনেরই নয় শ্রমজীবী ও পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যেও।
উন্নত গ্রন্থাগার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর ভাবনা-চিন্তা অনেক আলোচনার দাবি রাখে। গ্রন্থাগার সংগঠনে, তাঁর শ্রেণী চরিত্র নির্ধারণে, গ্রন্থাগারের সামাজিক ভূমিকার বিশ্লেষণে তাঁর গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সব কিছুই আজ গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়ে গেছে। গ্রন্থাগারের স্বাধীনতার সম্পর্কেও তিনি নিশ্চুপ ছিলেন না।
লেনিনের মতে, তখনকার মতো আজও গ্রন্থাগারকে রাজনীতিবর্জিত শ্রেণী নিরপেক্ষ একটি স্বাধীন সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে তুলে ধরার এক সযত্ন প্রয়াস রয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এতে সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু সমাজ যেখানে শ্রেণীবিভক্ত, পুঁজিবাদী নিয়মে নিয়ন্ত্রিত সেখানে তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী কর্তৃক গ্রন্থাগারকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সোল্লাস প্রচেষ্টায় সরলতা নেই। শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা ছাড়া তা সম্ভবও নয়।
স্বাধীনতার নামে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পক্ষে নিরন্তর কাজ করে চলেন তাঁরা। কখনও অজান্তে আবার কখনও সচেতনভাবে।
বিপ্লব সংগঠিত হবার পরেই যখন তিনি পেট্রগ্রাড পাবলিক লাইব্রেরি সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন, তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী ও গ্রন্থাগারমনষ্ক ব্যক্তিদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেনিন প্রকারান্তরে রাজনীতি ঢুকিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছেন।
তৎকালীন গ্রন্থাগার অধিকর্তা লেনিনের প্রস্তাব শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি বরং প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের মদতে লেনিনের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রচার চালিয়েছিলেন গ্রন্থাগারের স্বাধীনতা বিপন্ন। কমিউনিস্টদের হাত থেকে গ্রন্থাগারকে মুক্ত রাখতে হবে। এইভাবে স্বাধীনতার নামে গ্রন্থাগারকে যে স্বাধীন রাখা যায় না বরং তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় এবং তা যে পরাধীনতাই লেনিনই সেই কথা তুলে ধরেন।
বুর্জোয়াদের দ্বারা পরিচালিত গ্রন্থাগার ব্যবস্থাতেও যে শ্রেণীস্বার্থ জড়িত থাকে এবং বুর্জোয়া ব্যবস্থা হিসাবে তাঁরা দেখতে চান লেনিন তা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়ে গ্রন্থাগার ব্যবস্থায় নব জোয়ারের সৃষ্টি করেন। ১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি যে প্রস্তাব এনেছিলেন ১৯১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি ‘কাউন্সিল অব পিপল্স কমিশার’- এর একটি সভা থেকে তা পাস করিয়ে নেন। সাথে সাথে ওই লাইব্রেরির অধিকর্তার অপসারণ ঘটিয়ে প্রস্তাবগুলি রূপায়ণের কাজ শুরু করা হয়।
লেনিনের মতে গ্রন্থাগার যেহেতু সামজিক প্রতিষ্ঠান, তাই সামাজিক কার্যকলাপের সাথে এর নিবিড় সংযোগ। তার ফলে সুবিধাবাদী ঝোঁক, বুর্জোয়া-নৈরাজ্যবাদী ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঝোঁকগুলিও গ্রন্থাগার ব্যবস্থায় ক্রিয়াশীল থাকে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করেই গ্রন্থাগারকে স্বাধীন করতে হবে। এই বিষয়গুলিকে এড়িয়ে নিয়ে গ্রন্থাগারকে স্বাধীন রাখার প্রয়াস আসলে বুর্জোয়াদের একটি সচেতন ভন্ডামি মাত্র।
বুর্জোয়া নিয়ন্ত্রিত স্বাধীন গ্রন্থাগার ব্যবস্থায় স্ব-শ্রেণীভুক্ত পাঠকের সাথে সাথে কতিপয় অসাধারণ মেধাবী পাঠক গোষ্ঠী তাঁদের প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাবে সত্য, কিন্তু জনসাধারণের গ্রন্থাগার ব্যবস্থায় শ্রমজীবী জনগণের গ্রন্থাগারমুখী হবার কোনো উপায় থাকবে না।
‘গ্রন্থাগার সকলের জন্য’ প্রচার করা হলেও সেই সুযোগ গ্রহণ করবার সামর্থ্য ও মানসিকতা না থাকার কারণে তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পক্ষেই সমর্থন যুগিয়ে যাবে। বেশিরভাগ মানুষই গ্রন্থাগারকে তাঁদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভাবার পরিবর্তে গ্রন্থাগার ব্যবস্থার আওতা থেকে অনেক দূরে সরে যাবে এবং জীবন সংগ্রামে জর্জরিত হয়ে সস্তা আমোদে গা ভাসিয়ে দেবে।
এই অবস্থাটা তৈরি হোকÑ বুর্জোয়ারা তা কামনা করে। বুর্জোয়া মতাদর্শের এ এক কৌশল। এর ফলে আবার যাতে সমাজে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, শ্রমিক শ্রেণী যাতে চন্ডমূর্তি ধারণ না করে বসে তাই বুর্জোয়া মতাদর্শকে শ্রেণী নিরপেক্ষ মতাদর্শ হিসাবে প্রচার করা হয় এমনভাবে যাতে তাঁরা অভ্যাসবশত এই মতাদর্শকেই নিজস্ব শ্রেণী চেতনা হিসাবে ভাবতে শেখে।
ফলে একটা সময় শোষক শ্রেণীর নিজস্ব চেতনা সমাজের সর্বস্থরের মানুষের চেতনা হিসেবে প্রচার করার প্রয়াস নেওয়া হয়। অনেকে একে মূল্যবোধের অবক্ষয় বলে থাকেন। একে অবক্ষয় না বলে বরং বলা যায় এ এক নতুন বুর্জোয়া মূল্যবোধের উত্তরণ। এই মূল্যবোধের বিকাশে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গ্রন্থাগারের শ্রেণী নিরপেক্ষতার নামে পুঁজিবাদের মুখপাত্র হিসাবে কাজ কারে থাকে।
লেনিনের সময়কালেও যেমন এই ধরণের বুদ্ধিজীবীর সমাগম ঘটেছিল লেনিন পরবর্তী যুগেও এই ধরনের বুদ্ধিজীবীর সমাগম হতে দেরি হয়নি। শ্রেণী সংগ্রামকে অপ্রয়োজনীয় বলে তুলে ধরে ছদ্মবেশী বুদ্ধিজীবী বিপ্লবীরা যে কতটা ভয়ানক হয়ে উঠতে পারেন, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তো সাবেক সোভিয়েতই হতে পারে। এই সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুফল গ্রহণ করেছেন। গ্রন্থাগার ব্যবস্থায় বিপুল গ্রন্থসম্ভার আর অঢেল সুযোগ এরা গ্রহণ করেছেন।
সমাজবিকাশের নানা জটিল সমস্যা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। বহু মার্কসবাদী তাত্তি¡কেরও জন্ম হয়েছে সেখানে। মার্কসবাদের আলোকে বহু গবেষণাধর্মী গ্রন্থও লিখে ফেলেছেন তাঁরা। কিন্তু শ্রেণী সংগ্রামের বিষয়টাকে শিকেয় তুলে দেওয়া হয়েছে। শ্রেণী সংগ্রামের এই শিথিলতা আর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে সে দেশেও প্রতিবিপ্লব ঘটে গেল। ওই সমস্ত মার্কসবাদী তাত্তি¡ক আর বুদ্ধিজীবীমহল কিন্তু প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো হয়ে গেল।
আসলে সমাজতন্ত্র কোনো স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনের উদাহরণ নয়, এর জন্য প্রস্তুতি দরকার, অধ্যায়ন দরকার। অধ্যয়ন আর শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই একটি যথার্থ বিপ্লবী দল গড়ে ওঠে। সমাজ পরিবর্তনে এই ধরনের দল গঠনে অধ্যয়ন ও শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যেকার ভারসাম্যটাই জরুরি।
অধ্যয়ন আর অভিজ্ঞতালব্দ জ্ঞানও যে পরষ্পর দ্বন্ধমূলক এই চেতনা থেকেই তিনি গ্রন্থাগার আন্দোলনেও নিয়ে এসেছিলেন এক নতুন ধারা। গ্রন্থাগারকে গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবার লড়াইয়েও তাঁর অবদান ছিল অসামান্য।
সংকলন: প্রদোষকুমার বাগচী, ‘লেনিনের গ্রন্থাগার ভাবনা ও অধ্যয়ন’ (প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০০১, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, কলকাতা)