লাওয়ে জাদি : কতটা প্রাচীন বৌদ্ধদের এই ঐতিহাসিক স্থাপনা?

জাদি

শিরুপন বড়ুয়া

বর্তমান যখন গত হয়ে অতীত হয়ে যায়, তখন তা ইতিহাসের পাতায় স্থান নেয়। তাই ইতিহাসের সাথে প্রাচীনত্বের একটা সম্পর্ক আছে বৈকি। কিন্তু শুধুমাত্র প্রাচীনত্বই কোন ঐতিহাসিক বিষয়ের গুরুত্ব বাড়ায় না। বরং আরো অনেক কিছুই এর সাথে জড়িত থাকে। যেমন ৭১ এর স্বাধীনতার ইতিহাস। যেন এইতো গতকালের কথা। সময়ের হিসেবে প্রাচীন বলা যাবে না কোনভাবেই। তাই বলে কি এর গুরুত্ব কম? প্রশ্নই আসে না।

আমাদের রামু উপজেলায় ইতিহাসের এরকম অনেক উপাদান আছে যা সময়ের হিসেবে প্রাচীন নয়। কিন্তু আমাদের মনে একটা বিষয় গেঁথে গিয়েছে যে, কোনকিছু ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্ব পেতে গেলে এর প্রাচীনত্ব প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। এটা করতে গিয়ে আমরা বার বার সঠিক ইতিহাস থেকে সরে আসি। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

তেমনি একটি বিষয় ‘রামুর লাওয়ে জাদি’। রামু উপজেলার অন্যতম একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হচ্ছে লাওয়ে জাদি (Zedi), যা রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি রাস্তার পূর্ব পাশে একটি সুউচ্চ পাহাড়ে অবস্থিত। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার আসার পথে রামু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকায় আসলেই পূর্ব দিকে তাকালে অনেক দূর থেকে এই জাদি (Zedi) দেখা যায়।

এটি আসলে একটি বৌদ্ধ স্তুপ (Stupa) বা প্যাগোডা। কথিত আছে যে, নির্মাণের পর এটিকে আরো দু’বার সংস্কার করা হয়েছিল, এবং প্রতিবার এটির আকার পূর্বের চেয়ে বড় করা হয়। সর্বশেষ উ দ অং (Doe Aoung) জাদিটির বর্তমান বিশালকার রুপ প্রদান করেন। উ ফা প্রু সওদাগরের ছেলে এবং দানবীর উ খিজারী সওদাগরের ছোট ভাই উ দ অং সওদাগর সম্ভবত রামু চৌমুহনীতে অবস্থিত বিশাল দিঘিটি খনন করার সময়ই এই জাদীর বর্তমান রুপ দেন। অর্থাৎ বর্তমানে আমরা জাদিটির যে বিশালাকৃতি দেখছি সেটি শুরুতে এত বিশাল ছিল না।

রামু তো বটেই, একসময় চট্রগ্রামও আরাকানের অধীনে ছিল। তাই এই এলাকায় এ ধরনের বেশ কিছু বৌদ্ধ স্তুপ বা জাদি চোখে পড়ে। রামুতে অবস্থিত এই জাদির নির্মাণশৈলি পুরোপুরি আরাকানিজ নয়, এতে কিছুটা বার্মিজ স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এই জাদি স্থানীয়ভাবে লাওয়ে জাদি নামে পরিচিত।

যদিও লাওয়ে নামক কোন ব্যক্তি এটির নির্মাণ করিয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে কোন লিখিত প্রমাণ নেই। আজ পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোন শিলালিপিও আবিস্কৃত হয়নি। রামু’র লেখক,শিক্ষক এবং গবেষক ধনিরাম বড়ুয়া তাঁর ‘রামুর প্রাচীন স্থাপত্য এবং ঐতিহ্য ‘ নামক বইয়ের ৪২ নং পৃষ্ঠায় এই জাদিটি লাওয়ে মোরাং আনুমানিক ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করেন মর্মে উল্লেখ করেন।

তাছাড়া বহু অনলাইন পত্রিকা এবং স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই জাদিটিকে প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো বলে দাবী করা হয়েছে। যদিও লেখা গুলো প্রায় সব একটা থেকে অন্যটা কপি করা। তাই নতুন কোন তথ্যই নেই। এই জাদি সম্পর্কে অনেকটা ভিন্ন এবং নতুন তথ্য পাওয়া যায় ‘রামুর প্রাচীন স্থাপত্য এবং ঐতিহ্য’ বইটিতে। তারপরও একটি প্রশ্ন রয়ে যায়।

এই জাদিটি আসলেই কি ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করা হয়েছিল? আসলেই কি এটি ৩০০ বছরের প্রাচীন? কতটা প্রাচীন এই জাদি?

আমার মতে যদি লাওয়ে মোরাং এটির নির্মাতা হন, তবে বলতেই হয় যে এই জাদির নির্মাণকাল আরো অনেক পরে। এই জাদির নির্মাণকাল সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে আগে জানতে হবে লাওয়ে মোরাং লোকটাইবা কে? তিনি কি রামু’র কোন জমিদার বা স্থানীয় কোন ব্যবসায়ী ছিলেন?

উত্তর গুলো পাওয়ার আগে চলুন ফিরে যাই ১৭৬০ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর দিনটিতে। কারণ এই দিনই বাংলার বিশ্বাস ঘাতক মির জাফরের জামাতা নবাব মির কাসিমের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক চুক্তির মাধ্যমে চট্রগ্রামসহ রামু সরাসরি ইস্ট ইন্ডিয়ার অধীনে চলে যায়। রামু হয়ে যায় বেঙ্গল প্রভিন্সের সর্ব দক্ষিণের ব্রিটিশ মিলিটারি পোস্ট।

তারও আগে ১৬৬৫ সালে মোগলরা চট্রগ্রাম এবং রামু দখল করে। কিন্তু আদিকাল থেকেই রামুতে আরাকানীজদের শাসন এবং বসবাস ছিল, এমনকি আরাকানে কোন সমস্যা হলে ওখান থেকে পরাজিত পক্ষ নাফ নদী পাড়ি দিয়ে রামু হয়ে চট্রগ্রামে পালিয়ে আসত।

তারই ধারাবাহিকতায় ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন আরাকান রাজার সেনাপতি থান্ডি বা থানডৌ’র (চিন পিয়ান,বা কিং বেরিং, যাকে আমরা কানা রাজা হিসেবে চিনি, তাঁর পিতা) বিশ্বাসঘাতকতায় বর্মি রাজ যখন আরাকান দখল করে নেয়,তখন স্বাধীন আরাকান রাজার অপর এক ভাই লাওয়ে মোরাং নাফ নদী পার হয়ে বেঙ্গল প্রভিন্সের বর্তমান টেকনাফে আশ্রয় নেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন ।

লাওয়ে মোরাংকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুশিমনে তাদের শাসনাধীন এলাকায় আশ্রয় দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই আরাকানিজ রাজপুত্রকে নাফ নদীর উত্তর দিক হতে রেজু খালের দক্ষিণ দিক পর্যন্ত এলাকায় (বর্তমান উখিয়া-টেকনাফ) থাকার অনুমতি প্রদান করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের কিছু নথিতে লাওয়ে মোরাং কে মগ সর্দার হিসেবে উল্লেখ করেছে।

কিছু নথিতে তাঁর নাম Lawha Murang, এবং আর কিছু নথিতে Lohomorang লেখা হয়েছে। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তাঁর নথিতে এই মগ সর্দার কে Lieng Murung নামে উল্লেখ করেন। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে একদল বার্মিজ সৈন্য নাফ নদী অতিক্রম করে এক মগ সর্দারকে গ্রেফতার করতে টেকনাফ আসে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেকর্ড অনুযায়ী সেই মগ সর্দার হচ্ছেন লাওয়ে মোরাং।

লাওয়ে মোরাং বর্মিদের হাত থেকে বাঁচতে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে টেকনাফ থেকে পালিয়ে রামু চলে আসেন। কিন্তু আরাকান গভর্নর চট্রগ্রামে কোম্পানির ম্যাজিস্ট্রেটকে সরাসরি চিঠি পাঠিয়ে জানায় যে, লাওয়ে মোরাং অন্তত ৩,৫০০ জন প্রজাকে সাথে নিয়ে আরাকান হতে পালিয়ে কোম্পানির শাসনাধীন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে, যার কারনে তাঁর এলাকায় রাজস্ব আদায় কম হচ্ছে।

তাই কোম্পানির উচিত লাওয়ে মোরাংকে তাঁর অনুসারী সহ বর্মি সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে বর্মি সৈন্যদের হাতে তুলে না দিয়ে উল্টো কোম্পানির এলাকায় বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করাটা যে একটা অপরাধ তা আরাকান গভর্নরকে বোঝাতে সক্ষম হয়। সৈন্যরা ফিরে যায়। কিন্তু লাওয়ে মোরাং রামুতেই রয়ে যান। তখন হয়তো কোন এক সময়ে তিনি রামুর জাদিটি তৈরি করেন।

তাহলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথি অনুযায়ী লাওয়ে মোরাং টেকনাফে অর্থাৎ বেঙ্গল প্রভিন্সে প্রবেশ করেন ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে,এবং আরো পরে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে আসেন রামুতে। তারমানে লাওয়ে জাদি যদি তিনি নির্মাণ করে থাকেন, তবে তা ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের পরেই করেছেন। কোনভাবেই ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের আগে নয়। আর যদি ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দকেই আমরা জাদির নির্মাণ সাল ধরি,তবে এই স্থাপনাটির বয়স এখন ২২৭ বছর, ৩০০ বছর নয়।

যদিও এর বর্তমান রুপটি ১৯০০ শতকের প্রথম দিকে নির্মাণ করা হয়। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত, Eastern Bengal District Gazetteers বইটিতে রামু’র জাদিটির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, কক্সবাজার শহরে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ জাদি বা প্যাগোডা আছে, যার একটি রামু’র জাদি হতে দেখা যায়। কেননা রামু’র জাদিটি অপেক্ষাকৃত একটি সুউচ্চ পাহাড়ে অবস্থিত।

সেই জাদিটি যে বর্তমানের লাওয়ে জাদি,তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তৎকালীন সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী রামু’র এই জাদি থেকে যদি কক্সবাজারে অবস্থিত অন্য একটি জাদি খালি চোখে দেখা যায়, তবে এই জাদির পাহাড় হতে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত এবং মহেশখালী দ্বীপ পরিস্কার আবহাওয়ায় খালি চোখে দেখা যাওয়ার বিষয়টিও কোন শোনা কথা নয়।

কিন্তু বর্তমানে বায়ু দূষণ বেড়ে যাওয়ায় এবং বহুতল ভবনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই বিষয়টি এখন অতীত। বর্তমানে এই জাদি মারাত্মক রকমের ঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশেষ করে এর পেছনে পাহাড়ের ভাঙ্গন জাদিটিকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

পত্র পত্রিকায় এ বিষয়ে অনেক লেখালেখি হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত তেমন কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজারের অন্যতম বৃহৎ এবং দুর্লভ এই জাদি বা প্যাগোডাটি শুধু বইয়ের পাতায় টিকে থাকবে। তেমনটা হলে রামু’র ইতিহাসের একটি মূল্যবান পাতা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে।

তথ্য সূত্র:
১। ধনিরাম বড়ুয়া, রামুর প্রাচীন স্থাপত্য এবং ঐতিহ্য।
২। The Calcutta Review, Vol.CXXIV (124),January 1907,Calcutta.
৩। L. S. S. O’Malley, Eastern Bengal District Gazetteers: Chittagong, 1908, Calcutta.
৪। Anil Chandra Banerjee, The Eastern Frontier of British India 1784-1826, First ed. September 1943, Calcutta.
৫। G.E Harvey, History of Burma.
৬। East India Company and Arakanese Refugee in Chittagong.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *