শিপ্ত বড়ুয়া
পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্নে প্রাকৃতিকভাবেই যৌনতার উদ্ভব হয়েছে, সেসময় মানুষ ইচ্ছেমত যৌনতায় লিপ্ত হতো। শুরুর যৌনতার ইতিহাস বেশ সুন্দর এবং ইতিবাচক। জৈবিক চাহিদা হিসেবে নারী-পুরুষের সম্মতিতে নারী-পুরুষ একে অপরের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়াত এবং এটা নির্ধারণ ছিলো না যে কে কার সাথে যৌন সম্পর্কে জড়াবে, এটা ছিলো তাঁদের স্বতন্ত্র পছন্দের জায়গা থেকে।
যাকে বর্তমানে আধুনিক সংস্কার হিসেবে বহু বিবাহ নাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আদিম যুগে ছন্নছাড়া প্রাণী থেকে মানুষ একেকটি গোহায় কয়েকজন করে বসবাস শুরু করার পরে যে ঘটনার উদ্ভব তা বিয়ে। আর এর মধ্য দিয়েই আজকের আধুনিক পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র প্রথার উন্মেষ।
গোহায় বসবাসের একটা সময় মানুষ নিজেদের মধ্যে যখন বদ্ধন অনুভব করতে লাগলো এরই মধ্যেই অবাধ যৌন সম্পর্ক তাদের মনে ছাপ ফেলে গেল। ড: ওয়েস্টমার্কের হিস্ট্রি অব হিউম্যান ম্যারেজ থেকে জানা যায়, মূলত পরিবার প্রথা সৃষ্টির কারণে যৌন সম্পর্কের মধ্যে মানুষ একটা রেখা টানলো যার নাম বিয়ে।
এখানে আরেকটি বিষয়কেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো সম্পত্তি। এটা অবশ্য অনেক পরের বিষয়। সম্পত্তির মালিকানা অর্পণের জন্য বিয়ের আইনি রূপকে দেখা যেতে পারে। আমরা বর্তমানে অনেক ধর্মমানবকে বলতে শুনি ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা, ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণেই বিয়ে প্রথার সৃষ্টি বলা হয় এখন, কিন্তু ড: ওয়েস্টমার্ক, মর্গান, বেকোফেনদের মতো নানান সমাজবিজ্ঞানীর তাত্তি¡ক আলোচনা পড়লেই বুঝা যাবে ধর্ম সৃষ্টির অনেক আগেই সৃষ্টি হয়েছিলো বিয়ে নামক যৌন সম্পর্কিত এক প্রথা যা যৌনতার একটি সংস্করণ মাত্র।
বরং এখন আমরা বলতে পারি, ধর্মীয় মূল্যবোধ, আইনি রেখা এবং সমাজের নৈতিকতা বিয়ে প্রথাকে আরো সুশৃঙ্খল করেছে মাত্র আর কিছু না।
নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা সহজেই বলি পুরুষ ও নারী উভয়েই মানুষ, বিয়ের পর নারী কেনো বাচ্চা লালন পালন. ঘর ধোয়া-মোছা, রান্না-বান্না করবে? সবার সমান অধিকার থাকা দরকার। কিন্তু এটা সত্য যে সভ্যতার শুরু থেকে পুরুষতান্ত্রিকতার চর্চা ব্যপকভাবে গড়ে উঠেছে যা এখন সিভিলাইজেশনের কারণে কিছুটা ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে।
আদিম যুগ থেকেই পুরুষ কেবল ঘরের বাইরে যেত আর নারী ঘর সামলানোর কাজ করতো। সে সূত্র ধরে আধুনিক ধর্মগুলো নারীদের অধিকার হরণ খুব সহজভাবেই করতে পেরেছে এবং গতানুগতিকভাবে তাঁদের ব্যাখ্যা চাপিয়েছিলো একদল অশিক্ষিত-গণমূর্খ-অসভ্য মানুষের উপর। আজকের এই দিনে নারী-পুরুষের যে সমান অধিকারের আন্দোলন তা অযৌক্তিক নয় বৈকি।
কারণ বিয়ে প্রথার বিবর্তনের ইতিহাস এই একই কথায় বলে। নারী-পুরুষ আসলেই মানুষ মাত্র, লিঙ্গভেদের কারণে কাজ ভিন্ন হওয়াটা বর্তমান সময়ে অস্বাভাবিক। আধুনিক আইন ও সমাজবিজ্ঞানীরা বিয়েকে নতুন এক নাম দিয়েছে যা হলো সিভিল কন্ট্রাক্ট (civil contract) বা সামাজিক চুক্তি।
যার যার মতো এখন নারী-পুরুষ আলাদা আলাদা সংগ্রাম করতে শিখে গেছে, সুতরাং যৌনতা এখন এখানে একপাক্ষিক নয় বরং ওপেন এবং ক্রস নিডেড (উভয়ের প্রয়োজনীয় অনুভূতি মাত্র)। যার কারণে যৌন সম্পর্কের সামাজিক লাইসেন্স পাওয়ার জন্যই কেবল এখন নারী-পুরুষ বিয়ে প্রথাকে এখনো মানছে।
তবে এটিও আমাদের মানা উচিৎ যে, আধুনিক সামাজিক কাঠামো এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারণে নারী-পুরুষ যেমন স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হতে শিখছে তেমনি নিজেদের মধ্যে সাম্য ও দুরত্ব ততই বাড়ছে। এখনো বিশ্বে অনেক প্রকার বিয়ে প্রথা প্রচলিত, আধুনিক বিশ্বে অনেকে আবার বিয়েকে অস্বীকার করার চিন্তাও করছে।
ব্যক্তি স্বাধীনতার চরম চর্চা করে লিভ টুগেদারের মতো সম্পর্ক গড়ে উঠছে, তা অবশ্য যৌনতার গোঁড়ার ইতিহাসের সুন্দর চর্চার আরেক ভার্সন। বিজ্ঞান ও মানুষের জ্ঞান চর্চার অবারিত সুযোগ মানুষের মনোজগৎ দিনকে দিন অহরহ পরিবর্তন করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। হয়তো বিয়ে প্রথা বদলে যেতে যেতে যৌন স্বাধীনতার স্বাদ নিতে নারী-পুরুষ উভয়েই বিপ্লব করে বসতে পারে।
বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর বিয়ে ও নৈতিকতা বইয়ে বেশ কিছু জটিল প্রশ্নের আলোকপাত করেছেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিয়ে প্রথা ভেঙে পড়লে কিংবা অবাধ যৌন সম্পর্ক মানুষ মেনে নিতে থাকলে হয়তো সমাজের অনেক বড় ক্ষতি হবে এমন চিন্তা আমাদের আসে কিন্তু তা মানুষের নয় বরং শাসকদের ক্ষতি হবে বেশি।
বিয়ে প্রথা ভেঙে ইতিমধ্যেই পড়েছে তা কেবল আমরা খালি চোখে দেখছি না। বিয়ের আউটপুট হিসেবে সহজ চিন্তা করলে দেখতে পাই সন্তান উৎপাদন। এছাড়া আর কিছু নয়। রাষ্ট্র বিয়ে নামক সামাজিক এক নিরব বৈধ নামক কুখ্যাত রীতি ভাঙতে দিতে চায় না কারণ সে জানে মানুষকে পরষ্পর স্বাধীন ও বন্ধনহীন হতে দিলে শাসনব্যবস্থায় চরম ঘনঘটা নেমে আসবে।
তখন কেবল একদল মানুষ এই পৃথিবী শাসন করতে পারবে না, সবাই খাবারের জন্য, মৌলিক অধিকারের জন্য সরকারের গদি ধরে টান দিতে দুই মিনিটও ভাববে না। তাই বিয়ে কেবল পূর্ণ নির্দিষ্ট যৌন স্বাধীনতায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, একে বৃদ্ধ বয়সে নিজেদের ভরণপোষণ, সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সন্তান উৎপাদনের মতো থিওরি আধুনিক চর্চায় রাখা হয়েছে।
বিয়েকে গ্রীক দার্শনিক প্লেটো তার রিপাবলিকে সমালোচনা করে লিখেন যে, বিয়ে হচ্ছে প্রকৃতি এবং মানুষের শত্রæ, যা মানুষকে ধ্বংস করে। ভাবা যায়? ৩৮০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে এমন চিন্তা তিনি করতে শিখেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ বিয়ে সম্বন্ধে খুব বেশি আলোকপাত করার প্রয়োজন মনে করেননি। তিনি আলাদাভাবে শুধুমাত্র বিয়ের বন্ধন নয় সর্বপ্রকার বন্ধন হতে দুরত্ব বজায় রাখতে বলেছেন এবং এখানেই তাঁর মুক্তি রচনা।
তাছাড়া দেখা যায় ঊনিশ শতকে বেশ কিছু নারী যেমন ম্যারি হায়েস, সারা ফিল্ডিং, ম্যারি ওলস্টোনক্রাফট বিয়েকে একপ্রকারের পতিতাবৃত্তি বলেছিলেন। তারা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেন যে, বিয়ে নারীর স্বাধীন স্বত্ত¡াকে বিনষ্ট করে এবং নারীকে পুরুষের ভোগ্যবস্তু করে তুলে।
বিয়ে সম্পর্কে এরকম আরো অনেকে নানান মন্তব্য করেন যা বিয়ে প্রথার বিরুদ্ধে। তাহলে কি তারা ওপেন সেক্স অথবা আনম্যারিটাল সেক্সে বিশ্বাস স্থাপন করতে চান? তা কখনোই তারা চান না, নারীর স্বাধীনতা নিয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে তারা কেবল বিয়ে প্রথা সম্পর্কে এমন মন্তব্য করে বসেছেন।
বিয়ে এবং যৌনতা সম্পর্কে খুব স্পষ্ট দার্শনিক যুক্তি দাঁড় করাতে পেরেছিলেন ডেনমার্কের দার্শনিক সরেন কিয়ের্কেগার্ড। তিনি দাবি করেন যে, বিয়ে হলো সুন্দর যৌনতার পথে একটি দেয়াল। প্রেমকে তিনি গভীরভাবে স্বীকার করেছেন এবং পারিবারিক বিয়েকে ঘৃণা করেছেন। ফ্রাঞ্জ কাফকারও প্রায় একই ধরণের মন্তব্য রয়েছে বিয়ে সম্পর্কে।
তিনি তাঁর ডায়েরী (Summary of all the arguments for and against my marriage: From Kafka’s Diaries) তে লিখেছেন বিয়ে মানুষের যৌন বিকাশ রুদ্ধ করে দেয় এবং সমাজে অনেক হিংসা এবং অহংকারের সৃষ্টি করে। আর সিমোন দ্যা বোভোয়ার তো আমাদের পড়া আছে নিশ্চয়। বিয়েকে এমনভাবে বর্ণনা করার পেঁছনে রয়েছে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা আর নারী স্বাধীনতার সুযোগ।
এখন বর্তমান সময়ে যৌনতা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য অপরাধ ধর্ষণের উৎপত্তি কোথা থেকে? প্রথমেই বলেছিলাম বিয়ে প্রথার আগে যৌনতা কতটা স্বাধীনভাবে চর্চা করতো আদিম মানুষজন। ধর্ষণের উৎপত্তি মূলত পরিবার-রাষ্ট্র-সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠার পর থেকেই। এবং ধর্ষণের হার কেমন হবে তা অটোমেটিক নির্ধারণ হয় রাষ্ট্রব্যবস্থার উপরেই।
আমরা যদি ফৌজদারি আইনের উদ্ভব বা যৌন অপরাধ বিষয়ক অপরাধের বর্ণনা এবং শাস্তির দিকে নজর দিই তাহলে দেখা যায় তৎকালীন ব্রিটিশ আইন প্রণেতারা রাষ্ট্রীয় শাসন সুবিধার জন্যই কিছু কিছু নতুন অপরাধ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করেছে এবং মানুষকে ইন-ডিরেক্টলি এসব অপরাধ করার মদদ দিয়েছে।
সে থেকে নারী আরো বেশি করে আটকে রাখার জন্য এবং পুরুষতন্ত্রের উন্নত চর্চা করার জন্য যৌন অপরাধের সকল দায়-দায়িত্ব দিয়েছে পুরুষের কাঁধে। এ জায়গায় পুরুষকে বরং জিইয়ে রাখার একটা চরম ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। সে থেকে আমাদের আধুনিক রাষ্ট্রও এখনো পুরুষতন্ত্রের চর্চা অব্যহত রাখার জন্য তাঁদের প্রয়োজনমতো অপরাধের সৃষ্টি এবং জনগণকে এনিয়ে আলোচনায় যথেষ্ট ব্যস্ত রাখতে প্রায়শ সফল হয়।
সেক্স ওপেন কিংবা কন্ট্রাক্ট সেক্স বা ম্যারেজ যে নামেই হোক না কেনো মানুষের মনমানসিকতার দায়ে মানুষ যৌনতা খুঁজবে সেটা কেমন হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব কেবল রাষ্ট্রকে নিতে হবে। তাহলেই যৌনতায় জোরাজোরি বা ধর্ষণ নামক অপরাধটি কমে আসবে। ঘরে-বাইরে ধর্ষণ হয়, নারীও পুরুষকে ধর্ষণ করে, পুরুষও নারীকে ধর্ষণ করে।
সেক্স আরো বেশি স্বাধীন হোক, আনম্যারিটাল অথবা ম্যারিটাল। ভালোবাসা ছোঁয়া লাগুক ধর্ষকের মনে-প্রাণে। জগতের সকল প্রাণী যৌনসুখী হোক।