বৌদ্ধ দর্শন ও ডাইলেকটিক্যাল বস্তুবাদ

নীরুকুমার চাকমা

বৌদ্ধ দর্শনের ইতিহাস সুবিশাল ও বিস্তৃত; এর শাখা-প্রশাখাও বিশাল ও বৈচিত্রময়। বুদ্ধের সুমহান বাণী, উপদেশ ও চিন্তাধারাই এ দর্শনের মূল উৎস ও ভিত্তি। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরবর্তীকালে তাঁর শিষ্য ও অনুগামীদের নিয়ে কয়েকবার মহাসঙ্গীতি বা মহাসম্মেলন অনুষ্টিত হয়েছিলো এবং তারই মাধ্যমে বুদ্ধের উপদেশ ও বাণী সূত্রপিটক, বিনয়পিটক ও অভিধম্মপিটকে ত্রিপিটকে লিপিবদ্ধ করা হয়।

এই ত্রিপিটক অনেকগুলো গ্রন্থের সমষ্টি। সূত্রপিটকে বুদ্ধের উপদেশ, বিনয়পিটকে বৌদ্ধ সংঘের নিয়মকানুন এবং অভিধম্মপিটকে দার্শনিক তত্তে¡র আলোচনা আছে। বৌদ্ধদর্শন কিন্তু এই ত্রিপিটকেই শুধুমাত্র সীমাবদ্ধ নয়। বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তাঁর বাণী ও উপদেশকে কেন্দ্র করে অনুগামীদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ফলে অনেক দার্শনিক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে।

নাগসেন, নাগার্জুন, বুদ্ধঘোষ, বসুমিত্র, অসঙ্গ, কত্যায়নী, বসুবন্ধু, যশোমিত্র, ভদন্ত প্রভৃতি অনেক বৌদ্ধ দার্শনিক বৌদ্ধদর্শনকে নানাভাবে সমৃদ্ধিশালী ও বৈচিত্রময় করেছেন। তাঁদের দর্শনের বিচিত্র গতিধারা নানাদিক প্রসার লাভ করে এবং পাশ্চাত্যের অনেক ভাবধারা এতে বহুলাংশে প্রভাবান্বিত হয়েছে বলে অনেকেরই বিশ্বাস।

বৌদ্ধদর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্বাধীনচিন্তার এক অকৃত্রিম গতিছন্দ। এ গতিছন্দ যুগে যুগে বিকশিত হয়েছে বিচিত্র ভঙ্গিমায়। ধর্মের কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস এ দর্শনকে কলুষিত করতে পারে নি কোনদিন। অলৌকিক ধ্যানধারণা ও রহস্যবাদ যুক্তির প্রখরতায় বিলীন হয়ে গেছে চিরতরে। অতিজাগতিক ও অতীন্দ্রিয় ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের অন্ধবিশ্বাস এ দর্শনে ঠাঁই পায় নি কোনদিন। যুক্তির স্বচ্ছতা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এ দর্শনের প্রাণ। এ দর্শন তাই নিজস্ব এক স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল ও আপন বৈশিষ্ট্যে প্রাণবন্ত ও ঐশ্বর্যময়।

সাধারণ অর্থে বুদ্ধ দর্শনচর্চা করেন নি; তা তিনি পছন্দ করতেন না। সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ আছেন কি নেই, জগৎ নিত্য না অনিত্য এসব বিরুদ্ধ দার্শনিক তত্ত্বালোচনায় তিনি নিজেকে আবদ্ধ করেন নি কোনদিন। কেননা তিনি মনে করতেন জীবন-সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এগুলোর কোনো ভূমিকা নেই।

দর্শনচর্চায় বিরূপ হলেও তাঁর চারটি ‘আর্যসত্য’ প্রচারের মাধ্যমে তিনি এমন মূল্যবান দার্শনিক মতবাদের প্রণয়ন করেছেন যে দর্শনের ইতিহাসে তা এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। তারই একটি হচ্ছে ডাইলেকটিক্যাল বস্তুবাদ।

বুদ্ধ এবং তাঁর অনুগামী বৌদ্ধ দার্শনিকগণ সবাই ছিলেন ডাইলেকটিসিয়ান। অসঙ্গ ও নাগার্জুন ভাববাদী হলেও ডাইলেকটিসিয়ান। জার্মান দার্শনিক হেগেলও ডাইলেকটিসিয়ান, তবে তিনি ছিলেন ভাববাদী। গ্রিসের প্রথম ডাইলেকটিসিয়ান হচ্ছেন হেরাক্লিটাস। অনেকের মতে তিনিই ডাইলেকটিকস প্রণেতা।

এ বক্তব্য কিন্তু কোনমতেই মেনে নেওয়া যায় না। কেননা হেরাক্লিটাসের বেশ কয়েক বছর পূর্বেই বুদ্ধ এ সত্য আবিষ্কার করেন।

‘ডাইলেকটিকস’ কথাটি গ্রিস শব্দ ‘ডায়ালগ’ থেকে উদ্ভূত। এর মানে হল তর্ক বা আলোচনা। প্রাচীণকালে গ্রিক দার্শনিকেরা তাদের বিরোধী পক্ষের মতের স্ববিরোধিতা আবিষ্কার করে যুক্তি দিয়ে তা খন্ডন করতেন। তর্কের এই কৌশলের নামই ডাইলেকটিকস। যুক্তির এই পদ্ধতিকে পরবর্তীকালে দার্শনিকগণ প্রাকৃতিক ঘটনা, মানুষের সমাজজীবন ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন।

ডাইলেকটিকসের মতে প্রকৃতির বিকাশ হয় পরষ্পরবিরোধী শক্তির ক্রিয়ার ফলে, স্ববিরোধী শক্তির বিকাশের জন্য। মার্কস প্রাকৃতিক ঘটনা পর্যালোচনার জন্য যে প্রণালী ব্যবহার করেন তা হল ডাইলেকটিক্যাল এবং ঘটনাগুলোর তিনি যে ব্যাখ্যা প্রদান করেন তা হল বস্তুবাদী। এজন্য তাঁর মতবাদকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদও বলা হয়ে থাকে।

ডাইলেকটিকসের মতে প্রাকৃতিক ঘটনাপুঞ্জ চিরপ্রবাহমান, নিত্য পরিবর্তনশীল। প্রকৃতি যেন এক অবিভক্ত সমগ্র, যার সমস্ত ঘটনা পরষ্পর নির্ভরশীল, একটি অপরটির সঙ্গে গ্রথিত ও সম্পর্কিত। এখানে চিরস্থায়ী অপরিবর্তনীয় বলে কিছু নেই আছে এক অবিরাম প্রবাহ, পুরাতনের ক্ষয় ও নতুনের আবির্ভাব। আপাতদৃষ্টিতে কোনো বস্তুকে স্থায়ী মনে হলেও আসলে তা স্থায়ী নয়।

তার ধ্বংস অনিবার্য। সমস্ত প্রকৃতিতে ক্ষুদ্রতম জিনিস থেকে বৃহত্তম জিনিস পর্যন্ত চলছে এক অবিরাম প্রবাহÑআবির্ভাব ও তিরোভাবের একটানা ছন্দ। এটাই ডাইলেকটিকসের কথা এবং এটাই বুদ্ধ ও বৌদ্ধ দার্শনিকদের মূল বক্তব্য। মার্ক্স ও এঙ্গেলসের মতো বুদ্ধ সর্বতোভাবে একজন বস্তুবাদী।

তাঁর প্রচারিত ধর্মে ঈশ্বর নেই, আত্মা নেই, পরলোক নেই আছে শুধু অবিরাম প্রবাহ, পরিবর্তন ও রূপান্তর। সমগ্র বিশ্বে চলছে এক নিয়মের অধীনে। এই প্রাকৃতিক নিয়মের নামই ‘ধম্ম’ বা ‘ধর্ম’।

বুদ্ধের মতে নিত্য, অপরিবর্তনীয়, চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর বলে কিছু নেই। জগতের সমস্ত জিনিসই পরিবর্তনশীল সারা বিশ্বে চলছে বস্তুর বিরামহীন পরিবর্তন ও রূপান্তর। আমাদের জীবন-হচ্ছে এক অবিরাম প্রবাহ, আবির্ভাব ও তিরোভাবের একটানা ছন্দ-জন্ম-মৃত্যুর একটানা শ্রোত। জগতে শ্বাশত সত্তা বলে কিছুই নেই, আছে শুধু উৎপাদ্যমান, পরিবর্তন-ইংরেজীতে যাকে বলা হয় বিকামিং। বৌদ্ধ দার্শনিকরা এর নাম দিয়েছেন ভব।

বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে সমগ্র জগতে চলছে এই উৎপাদ্যমান বা ভবের খেলা, জগৎ নিত্য পরিবর্তিত হচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে ঘটছে তার রূপান্তর, প্রতি ক্ষণে ক্ষণে চলেছে আবির্ভাব ও তিরোভাব। অস্তি ও নাস্তি, হ্যাঁ ও না’র মিছিল চলেছে এখানে যুগপৎ।

প্রদীপের শিখা যেমন নিয়ত পরিবর্তিত হয় অথচ দুটি অবস্থার মধ্যে ব্যবধান না থাকায় এই ধারাবাহিকতার জন্য একই দীপশিখা মনে হয়, তেমনি আমরা যা সত্তা মনে করি আসলে তা উৎপাদ্যমান বা ভব-প্রতিনিয়তই তার পরিবর্তন হচ্ছে।

একমাত্র দ্রুত পরষ্পরার জন্যই জগৎকে শ্বাশত বলে মনে হয়-কোনো জিনিসকে স্থায়ী মনে হয়। আসলে জগতে চলছে অন্তহীন বিরামহীন একটানা পরিবর্তনের শ্রোত, গতি ও প্রবাহ। একটি জিনিসের উৎপন্ন হচ্ছে, অপরটির বিনাশ হচ্ছে বর্তমান হয়ে যাচ্ছে অতীত, ভবিষ্যৎ হচ্ছে বর্তমান।

বুদ্ধের মতে জগতের সমস্ত বস্তুই কার্যকারণ শৃঙ্খলাবদ্ধ-কারণ নিরপেক্ষ কোনো জিনিস নেই। কোনো বস্তু স্বয়ং উৎপন্ন হয় না একটি ঘটনা আর একটি ঘটনা থেকে সঞ্জাত। সবকিছুই সমুৎপাদ বা উৎপত্তি লাভ করে পূর্বের ঘটনা থেকে।

বৌদ্ধদর্শনে এই তত্ত¡কেই বলা হয় ‘প্রতীত্য-সমুৎপাদ’। এই তত্ত্বানুসারে মানুষের (১) দুঃখের কারন জরা-মরণ, (২) তার কারণ জাতি বা জন্ম, (৩) তার কারণ ভব, (৪) তার কারণ উপাদান, (৫) তার কারণ তৃষ্ণা, (৬) তার কারণ বেদনা, (৭) তার কারণ স্পর্শ, (৮) তার কারণ ষড়ায়তন, (৯) তার কারণ নাম-রূপ, (১০) তার কারণ বিজ্ঞান, (১১) তার কারণ সংষ্কার এবং (১২) সংষ্কারের কারণ অবিদ্যা। এই অবিদ্যা নাশ হলে সংষ্কার থেকে আরম্ভ করে একে একে দুঃখের বিনাশ ঘটে। এই অবিদ্যা হচ্ছে চারটি আর্যসত্য সম্বন্ধে অজ্ঞতা (১) দুঃখ আছে (২) দুঃখের কারণ আছে (৩) দুঃখের নিবৃত্তি আছে এবং (৪) দুঃখ নিবৃত্তির উপায়ই বিখ্যাত অষ্টাঙ্গিক মার্গ নামে পরিচিত।

বুদ্ধের জীবনের লক্ষ্য ছিল দুঃখ থেকে অব্যাহতি নির্বাণলাভ। এই পথ উদ্ভাবন করতে গিয়ে তিনি জগৎ সম্বন্ধে পরিবর্তনশীলতার যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন তাঁর দর্শন হয়েছে সম্পূর্ণরূপে ডাইলেকটিক্যাল। ইউরোপীয় দার্শনিকদের বৌদ্ধদর্শনের সঙ্গে পরিচয় না থাকার ফলেই গ্রিস দার্শনিক হেরাক্লিটাসকে এর আবিষ্কারক বলে আখ্যা দিয়েছেন

প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধ এই সত্যটির প্রথম আবিষ্কারক। বুদ্ধ ছিলেন মার্ক্স ও এঙ্গলসের মতো বস্তুবাদী। কিন্তু বুদ্ধত্ব লাভের পর নিজের মতবাদ প্রচার ও সংঘের কাজে ব্যাপৃত থাকয় বুদ্ধ এ দর্শনের প্রতি বিশেষ কোনো দৃষ্টিই দেননি যেমন মার্ক্স ‘পুঁজি’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা এবং অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় ডাইলেকটিক্যাল বস্তুবাদ সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে কোনো গ্রন্থ রচনা করা সম্ভবপর হয়নি।

তবে মার্ক্সবাদ যেমন এঙ্গেলস, লেলিন ও ষ্ট্যালিনের হতে পূর্ণতা লাভ করে ঠিক তেমনি নাগসেন, বুদ্ধঘোষ, নাগার্জুন প্রমুখ বৌদ্ধ দার্শনিকদের হাতে বুদ্ধের ডাইলেকটিক্যাল বস্তুবাদী চিন্তাধারার পূর্ণ বিকাশ ঘটে।

সংকলন: নীরুকুমার চাকমা, ‘বুদ্ধ: ধর্ম ও দর্শন’(তৃতীয় সংস্করণ, ২০১৮, অবসর), বৌদ্ধদর্শন ও ডাইলেকটিক্যাল বস্তুবাদ, ৪৫।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *