বুড়ানি ছাগল

হাবিবুর রহমান

– হারমজাদা, কোন সোম কইছি গরুর মুসুরিডা টানাইতে, এহনও করছ নাই ক্যা?
– এহনি করতাছি, মা।

“এহনি করতাছি।” মুখটা বাঁকিয়ে ভেংচি কেটে বলল মা- “কোন সোম ধইরা কইতাছি, কতা কানে যায় না? খাড়ো, আহুক আইসকা তোর বাপ। কাম বাদ দিয়া খালি খেলা। তোর খেলা বাইর করবোনি আইজ।”
“উঁ…! কওগা আব্বারে।” সামনের পড়ে যাওয়া ফোকলা দাঁত বের করে ছেলে হেসে বলে- “আব্বা আমার কিছুই করবো না। আব্বা বাড়িতে আইতে আইতে তো আমি ঘুমাইয়াই পড়মু।”

“হ, কইছে তোরে। দেহা যাবোনি। এহন যে কাজ করবার কইছি তা আগে কর। মাইর যদি না খাবার চাস।” মা কলস থেকে পাতিলে পানি ভরে নিয়ে চলে গেল উনুনের কাছে রান্না করতে। উঠানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে মাটির হেঁসেল। কল পাড় থেকে হেঁসেল অব্দি কলস ভর্তি করে পানি টেনে নিতে মায়ের কষ্ট হয়।

“আইচ্ছা, করতাছি।” ছেলে মার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে- “কী রান্দিবা আইসকা, মা?”
“নাই হাক ভাজমু, আর কচুর পাতা ভত্তা দিমু।” মাটির ঢাকনা সরিয়ে মা ভাতটা দেখে নেয়।

– মা, হুকনা মরিচ দিয়া ভত্তা কইরো। হুকনা মরিচের ভত্তা খাইতে আমার খুব ভালা লাগে।
– আইচ্ছা, করমুনি। যা তো এহন সামনে থিকা। খালি বিরক্ত করছ।

ছেলে উঠে যায় না। মায়ের সামনেই বসে থাকে। মা কী করে তা চেয়ে চেয়ে দেখে। “ডাইল রান্দিবা না, মা? নাই হাকের সাথে ডাইল থাকলে সেই মজা!”
মায়ের গা যেন জ্বলে উঠে। কর্কশ কন্ঠে মা খেকিয়ে উঠে, “ডাইল রান্দিবা না! ডাইল কি তোর বাপ আনছে যে রান্দিমু? যা কইতাছি এইহান থিকা।”

ছেলে একটু সরে বসে। রঙ্গিন নকশা ছাপানো লুঙ্গির এক কোণ দিয়ে নাক পরিষ্কার করে। কিছু সময় দু’জনেই নীরব থাকে। একটু পর ছেলে সাহস করে বলে উঠে “মা, আমার বুড়ানি ছাগলের বাচ্চা হবো কবে?” উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়ের মুখের দিকে।

“হবো, এই ধর বিশ পঁচিশ দিন পরেই অইবো।” ছেলের দিকে না তাকিয়ে লাউ শাক কাটতে কাটতে মা জবাব দেয়।

– কয়টা বাচ্চা হবো, মা?
– কেমনে কমু? আমি কি জানি নাকি?
‘‘আমি জানি কয়টা হবো। কমু তোমারে?’’ ছেলের চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস ঝিলিক দিয়ে উঠে।

“হ, তুই তো জানবিই। ক দেহি কয়টা অইবো?” মা-ও রহস্য ভরা কন্ঠে প্রশ্ন করে।
– দুইটা বাচ্চা হইবো।
– হুম, তোরে তো ছাগলে কইছে। যা তো, আর বিরক্ত করিছ না। যেই কাম দিছি তা শেষ কর।

উনুন থেকে পোড়া খড়ি তুলে হেঁসেলের পাশে সরিয়ে রাখে মা। হেঁসেলের আঁচ কমে আসলে ঢাকনায় জমে থাকা ভাতের মাড় ফেলে দেয়। তারপর মাটির গামলা থেকে কচুর পাতা ধুয়ে একটু ঝাকি দিয়ে ভাতের উপরে দিয়ে দেয়।

ছেলে আবার বলতে শুরু করে- “দুই টা বাচ্চা হলে কি করবো, জানো মা?”
মা মাটির ঢাকনা দিয়ে ভাতের পাতিল ঢাকে- “উঁহু…।”

“একটা বাচ্চা আমি নিমু, আর একটা…….।” ছেলে বলতে একটু সময় নেয়। দৃষ্টি মায়ের দিক থেকে সরিয়ে মাটির দিকে নেয়। “আমার যে বুইন হবো, ওরে দিমু।”
মা এবার ছেলের দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোনায় একটু সলজ্জ হাসির রেখা ভেসে উঠে। কিন্তু ছেলে তা দেখতে পায় না। মা হাতের কাজ বন্ধ করে। কৌতুহলি হয়ে জিজ্ঞেস করে, “বুইন-ই যে হবো তরে কে কইছে?”
ছেলের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে, “আমি স্বপ্নে দেখছি।”
“দেখমু নি তহন কি অয়, বুইন না ভাই। যা তো এহন, দেখ গিয়া, ছাগলটা কোনহানে গেলো। আন্ধাইর হইয়া যাইতাছে চাইর দিক।” মায়ের কন্ঠে কোমলতা।
“আইচ্ছা।” বলে ছেলে উঠে চলে যায়।

মা রান্না শেষ করে। ভাতের পাতিল শাক ভাজির কড়াই থালা-বাসন সব কিছু ঘরে নিয়ে রাখে। তাদের ঘরটা মাটির দেয়ালে ঘেরা। উপরে ছন দিয়ে ছাওয়া। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে। কিন্তু ছেলে এখনও বাড়ি ফেরে না। মায়ের শরীরটা ভারি হয়ে আসে। রাগে গজগজ করতে থাকে। “আহুক আইজ বাড়িত। দেহামুনি খেলা কারে কয়। ওর একদিন কি আমার একদিন। এই পোলায় আমার আড্ডি জ¦ালাইয়া খাইলো।”

গোয়াল ঘরে গিয়ে গরুর জন্য মশারি টানায় মা- “একটা কাম যদি করে ঠিক মতন, তাইলেও অয়।” ছেলেকে বকতে থাকে একাএকা। সন্ধ্যে হয়ে আসে। মা ঘরে কেরসিনের কুপি জ্বালায়। সময় বাড়তে থাকে। কমতে থাকে রাগ। দুশ্চিন্তা শুরু হয় মায়ের মনে। মাঝেমাঝে বাহির বাড়ির দিকে তাকায় ছেলেকে দেখা যায় কিনা সেই আশায়। কিন্তু ছেলের দেখা মিলে না। মা ধৈর্য হারা হয়ে বাহির বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

“কোনো যাও? পোয়াতি মানুষ তুমি। এই সইন্ধ্যার সোময় বাড়ির বাইরে যাওয়া তোমার ঠিক অইবো না, জানো না?” পেছন থেকে বড় জা সাবধান করে দেয় মাকে। একই বাড়িতে থাকে দুই জা। উত্তরের ঘরে থাকে বড় জা। আর পূর্ব দিকের ঘরটা মায়ের।
মা একটু থমকে দাঁড়ায়। “পোলাড়া তো এহনও বাড়িতে আহে নাই, আপা।” কী যেন একটু ভাবে। তারপর বাড়ি থেকে বের হয়ে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে মা সামনে এগিয়ে যায়।

সূর্য ডুবে যাচ্ছে। রাস্তার পূর্ব-পশ্চিম দুই পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন জাতের জংলি গাছ। তাতে অন্ধকার আরও ঘন হয়ে আসে। পাশেই একের পর এক আনারস ক্ষেত। কোথায় যেন কুকুর ডেকে উঠে। মায়ের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। গা ছমছম করে উঠে। সন্তর্পনে সামনে এগিয়ে যায় মা।

হঠাৎ করেই সামনে দেখে তার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মাঝখানে। যেন একটি মূর্তি। কোন নড়াচড়া নেই। মা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। দ্রুত পায়ে ছেলের কাছে যায়। পেছন থেকে ছেলের দুই কাঁধে মায়ের দুই হাত রাখে। মায়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে ছেলের শরীরটা একটু কেঁপে উঠে। মা সামনে তাকায়।

জ্বলজ্বল করছে দুটি চোখ। যেন আগুন পড়ছে চোখ থেকে। জ¦লন্ত চোখ দুটি স্থির নিবদ্ধ হয়ে আছে ছেলের চোখের উপর। যেন চোখ থেকে দৃষ্টি সরলেই হামলে পড়বে প্রাণিটি। মুখের চারপাশে ফোটা ফোটা রক্ত লেগে আছে। মায়ের শরীর শক্ত হয়ে আসে। গলাটা শুকিয়ে যায়। মা জোরে শব্দ করে ডেকে উঠে কিন্তু কোন আওয়াজ বের হয় না। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছেলের কাঁধ আকড়ে ধরে।

মাটিতে শুয়ে আছে ছেলের আদরের বুড়ানি ছাগলটি। নিথর দেহ। পেট ফাড়া। পাশেই ছোট ছোট দুটি ছাগল ছানা। প্রাণহীন। বন্য শিয়ালের এক পা ছাগলের বুকের উপর। এই ছাগলের উপর এখন শুধুই ওর অধিকার। মা তার ছেলের কাঁধ শক্ত করে ধরে উলটা কদমে হাঁটে। কোন বাধা না দিয়ে ছেলেও মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটে যায়। তারা ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চলে যায়। ততক্ষণে সূর্য অস্ত গেছে।

habibur.rit@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *