শিপ্ত বড়ুয়া
“পড়, পড় এবং পড়”- মাও সেতুং। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেয়া সাঁকো” ও “ধন বল আয়ু বল, অন্যমনস্ক ব্যক্তির ছাতা বল, সংসারে যত কিছু মরণশীল পদার্থ আছে বই হচ্ছে সকলের সেরা। শ্রেষ্ঠ বইগুলো হচ্ছে শ্রেষ্ঠ বন্ধু”।
দেকার্তের মতে, “ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর সেরা মানুষদের সাথে কথা বলা”। নর্মান মেলর বলেছিলেন, “আমি চাই যে বই পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়”। “আমাদের আত্মার মাঝে যে জমাট বাধা সমুদ্র সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙার কুঠার হলো বই” ফ্রাঞ্জ কাফকার উক্তি।
এমন সব দারুণ কোটেশন আছে বইকে কেন্দ্র করে। বই পড়া আমাদের জীবনে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ এবং কেনো আমরা বই পড়বো তা নিশ্চয় অনেকের জানতে ইচ্ছে করে। প্রথমে বলে নেওয়া উচিৎ বই পড়া মানে কি? বই পড়া বলতে একাডেমিক গতানুগতিক সিলেবাসভিত্তিক বই মুখস্ত করে পরীক্ষা দিতে বসা নয়।
বই মানে শুধু একাডেমিক বইও নয়। বই পড়া একটি মুক্ত জগত, যেখানে লেখক প্রকাশ করেছে উন্মুক্ত চিন্তা এবং পাঠক পড়ে যাবে তার ইচ্ছে মতো তার যতটুকু দরকার। আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বই পড়া নিয়ে বিরক্তি আছে, আছে গ্লানি। বই বললেই তারা পালাতে চায়, ধৈর্য তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। কিন্তু বই পড়া মানে, সভ্যতার সাঁকো আরো বেশি মজবুত করে গড়ে তোলা।
তাহলে কিভাবে আমরা বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবো অথবা কিভাবে ধৈর্য ধরে পড়তে পারবো? প্রথমে আপনাকে যে কাজটি করতে হবে, আপনি যে কিছু জানার জন্যে বই পড়ছেন তা ভুলে যেতে হবে, চিন্তা করতে হবে মনের আনন্দে আপনি বই পড়ছেন। আপনার কোন তাড়া নেই।
আগেভাগেই আমার বই পড়ার নেশা কিভাবে শুরু হয়েছিলো তা আপনাদের সাথে শেয়ার করি। তখন আমি ক্লাস নাইনে, আমার কাকার গার্লফ্রেন্ড কাকাকে কাজী নজরুল ইসলামের ব্যাথার দান বইটি উপহার দিয়েছিলো, ঘটনাক্রমে বইটি আমার নজর কাড়ে এবং পড়তে বসে যাই।
সে বইয়ের একটা প্রবন্ধে “রাজবন্দীর চিটি” হয়তো সেদিন আমাকে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম, সে থেকে অদ্ভুত এক নেশা চেপে গেলো মাথায়। তারপরেও বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার কিছু সহায়িকা উপায় নিচে আলোচনা করলম।
নিয়ম করে বুক স্টোর কিংবা পাবলিক লাইব্রেরিতে ঘুরতে যান
বই পড়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কিছুই হতে পারে না। কতো সময়ই অনর্থকভাবে আমরা নষ্ট করে ফেলি। বই পড়ার অভ্যাস যদি আপনার গড়ে তুলতেই হয় আমার মতে আপনার প্রথম কাজ আপনার আশেপাশের বুক স্টুর কিংবা পাবলিক লাইব্র্রেরিগুলোতে ভিজিট করা।
নিয়ম করে এসব জায়গার গেলে বইয়ের প্রতি একটা ইম্পেথি তৈরি হবে। তাছাড়া একদিন না একদিন যেকোন বই আপনার নজর কাটতে পারে আর সেটা সংগ্রহ করার চিন্তা আপনার মাথায় আসবে। যদি সংগ্রহ হয়ে যায় তাহলে ব্যাস। এছাড়া বিভিন্ন বইমেলাতে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করাও এক্ষেত্রে জরুরী।
বই রিভিউ অথবা সরাসরি পড়ুয়া কোন বন্ধুর কাছে বই সমালোচনা আপনি চাইলে শুনতে পারেন এক্ষেত্রে সে নির্দিষ্ট বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়বে আর এভাবেই হয়তো শুরু হতে পারে বই পড়া।
আপনার পছন্দের ক্যাটাগরি সিলেক্ট করুন
আপনাকে বই পড়তে হলে আগে জানতে হবে আপনার কোন বিষয়ে আগ্রহ বেশি। সে আগ্রহ অনুযায়ী আপনি বই কিনতে পারেন অথবা আশেপাশে পাবলিক লাইব্রেরী থাকলে সেখান থেকে বই সংগ্রহ করতে পারেন। শুধুমাত্র বই পড়া কেনো? পূথিবীর সকল কাজ নিজ নিজ আগ্রহের বিষয়েই সবচেয়ে ভালোভাবে শুরু করা যায়, আপনার আগ্রহ আপনাকে প্রেরণা জোগাবে সবসময়।
যেমন আপনার হয়তো ইতিহাস কিংবা বিজ্ঞান বিষয়টা ভালো লাগে, সেক্ষেত্রে আপনি ইতিহাসের কিংবা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই সংগ্রহ করা শুরু করতে পারেন। ঠিক এভাবে আগে নির্ধারণ করুন কোন বিষয়ের উপর আপনার অধিক আগ্রহ এবং এর জন্য সময় নিয়ে ভাবুন।
নিয়ম করে বই সংগ্রহ করা ও পড়া
নিয়মিত বুক স্টোর কিংবা পাবলিক লাইব্রেরিতে গেলে আপনার বইয়ের প্রতি একটা ভালোবাসা কাজ করবে নিসঃন্দেহে। আপনার পছন্দের ক্যাটাগরি সিলেক্ট করা হয়ে গেলে এবার নিয়ম করে সে বিষয়ের উপর বই সংগ্রহ করা শুরু করুন।
বই সংগ্রহ করেই যে পড়া শুরু করে দিতে হবে এমন নয়, আপনার বিছানার পাশে বইগুলোকে ছিড়িয়ে-ছটিয়ে রাখতে পারেন অথবা এমন কোন জায়গায় রাখতে পারেন যেখানে আপনার চোখ পড়ে সবসময়। যখন ইচ্ছে আপনি বই খুলে বসে যেতে পারেন এবং যতটুকু ইচ্ছে পড়ে ফেলতে পারেন। এভাবে বই দেখতে দেখতে এবং পড়তে গিয়ে আপনার অজান্তেই আপনার মধ্যে হয়তো গড়ে উঠতে পারে বই পড়ার অভ্যাস।
একবার আপনার ভেতর বই পড়ার অভ্যেস গড়ে উঠলে এর সাথে সাথে আরো অনেকগুলো অভ্যেস আপনা আপনিই গড়ে উঠবে, যেমন ভ্রমণ, সিনেমা দেখা, ইন্টেলেকচুয়ালদের সাথে নিয়ম করে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি। বই পড়ার উপকার নিয়ে কথা বললে বোধহয় শেষ হবেনা, তারচেয়ে বরং আপনি নিজে বই পড়ার অভ্যেস গড়েই দেখুন এই জগৎ আপনাকে কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।
বলে রাখা ভালো যে, সাধারণত শিশু-কিশোর বয়সেই বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তোলার সবচেয়ে ভালো সময় কারণ এই বয়সে তাদের মেজাজ খুবই ইতিবাচক এবং দুঃচিন্তাহীন থাকে। তবে বিষয়টি এমনও নয় যে এই সময় পার করে আসলে আপনি বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তুলতে পারবেন না। আপনার চেষ্টা আপনাকে পৃথিবীর বাইরেও নিয়ে যেতে পারে। আরেকটি বিষয় বলা জরুরী।
বর্তমানে বই পড়ার বড় একটি অংশ কিন্ডল বুক কিংবা পিডিএফ বই পড়ার দিকে ঝুঁকেছে। বইয়ের হার্ডকপি অনেকের ক্ষেত্রে কিনে পড়া সম্ভব হয়না এক্ষেত্রে অনলাইনে অনেক ফ্রি পিডিএফ বইয়ের ওয়েবসাইট রয়েছে যেখান থেকে সহজেই বই ডাউনলোড করে পড়া যায়। তবে পিডিএফ পড়ে মূল বইয়ের আনন্দ কখনোই পাওয়া যায়না।
বই কিনতে বা সংগ্রহ করতে অপারগ হলে এই পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। সবশেষে আপনার বই পড়ার অভ্যেস গড়ে উঠুক এই আশা রইলো। মনের অন্ধকারাছন্ন স্থানে আলোর মশাল জ্বালার হয়তো একটিই রাস্তা – বই এবং বই।