‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ও অমর কথাশিল্পী শওকত আলী

মনির ইউসুফ

প্রদোষে প্রাকৃতজন শওকত আলীর একটি অনন্য সৃষ্টি। কথাসাহিত্যের সমস্ত রূপকল্প মাথায় রেখে বলা যায় যে, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে শ্রেষ্ঠ স্থানটি শওকত আলীর। মানব সভ্যতার ইতিহাসের যে ধারা তার থেকে মাটিযুক্ত প্রাকৃতজনের মুখের আর ইতিহাসের ভাষাকে পুষ্ট করে যে লেখক সভ্যতার গতিধারাকে যৌথ সমাজ কাঠামোর ইতিহাস বলে প্রথম উচ্চারণ করেন তিনি শওকত আলী।

সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ক গভীর মর্মভেদী চোখ থাকলে আর সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশকে শ্রেণি সমাজের ঐতিহাসিক দ্বান্ধিকতা দিয়ে বুঝলে একজন মানুষ এমন হৃদয় অব্যক্ত চেতনাকে নির্মাণ করতে পারেন। এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কেননা, এই ভূ-জগতে মানুষই তো সমস্ত সম্ভাবনার একমাত্র উৎস আর অনুঘটক

মানুষ এই অব্যক্ত বা বিমূর্ত চেতনাকে শনাক্ত করেছেন। সেদিক থেকে দেখলে বলা যায় শওকত আলী আমাদের চেতনা নির্মাণের প্রথম অগ্রনায়ক। মানুষের মুখের ভাষা নির্মাণকালে প্রাকৃতজনের যে শোভাযাত্রা অর্থাৎ বাঙালির যে উৎসযাত্রা তাকে তিনিই প্রথম সনাক্ত করেন এবং বাঙালির প্রত্যুষ না বলে তিনি প্রদোষকাল বলে বাঙালি সভ্যতার সূচনা কালের সন্ধ্যার আলোছায়ার ভেতর ফিরিয়ে নিয়ে যান।

কেননা, তখনও হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মীয় সংবর্তে প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসে তিনি আমাদের একটি বিষয় মনে করিয়ে দেন, ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণশঙ্কর আর্যদের আক্রমণে প্রাকৃতজন অনার্য বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ত্রাহি অবস্থা। সেই সময় সনাতন বা হিন্দু ধর্ম পালনকারী ব্যতিত অন্য কোন ধর্ম পালনকারী মানুষ এই বঙ্গীয় ভূখণ্ডে নিরাপদ ছিল না। সামন্ত-মহাসামন্তীয় রাজাদের অত্যাচারে প্রতিটি অঞ্চলে এমন ঘনায়মান অন্ধকার অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল এ দেশের অনার্য প্রাকৃতজনেরা দলে দলে পালিয়ে বেঁচেছে।

মানুষের কোনো মর্যাদাবোধ ছিল না তখন, হিন্দু সামন্তীয়রা বৌদ্ধ প্রাকৃতজনকে এমন নিপীড়ন করেছে এই বৃহত্তর বঙ্গে প্রাকৃত ভূমিতে তারা আর স্থান পায় নাই। তারা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশি বিভিন্ন দেশে, পাহাড়ে-জঙ্গলে। যে কারণে বৌদ্ধদের দেশ হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধদেরই এই দেশ ছেড়ে পালাতে হয়।

সেটি সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে এদেশের একমাত্র চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া এতো বড় বঙ্গীয় ভূমিতে কোন

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অবশিষ্ট ছিল না, একজনও না। ইতিহাস কি নির্মম! এই সময়ে এসে আমরা যেমন দেখেছি,বার্মা (মিয়ানমার) থেকে বৌাদ্ধরা রোহিঙ্গাদের যেভাবে দেশছাড়া করছে ঠিক একইভাবে ঐ সময় হিন্দুরা বৌদ্ধদের দেশ ছাড়া করেছিল।

সেই সময় সমাজে যে মাৎস্যন্যায় ঘটেছিল ইতিহাসে তা তুলনাহীন এক ঘটনা। লিখিত ইতিহাসের সাম্প্রতিকতম সত্য থেকেও আমরা জানি যে, ‘গৌড়ের হিন্দু রাজা শশাঙ্ক পূর্ব ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নির্মূল করার জন্য বাংলা ও বিহার অঞ্চলে যে বৌদ্ধ নিধন-যজ্ঞ চালায় তার ফলে বৌদ্ধরা প্রান্তীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন নেপাল, তিব্বত, ভূটান, এবং সমতট ও হরিকেল (পূর্ব বাংলা) আর বর্মা অঞ্চল।

ব্রহ্ম দেশ এর ‘ব্রহ্মা’ শব্দটাও ভারতীয়। উড়িষা, অসম, বাংলা ও বার্মিজ ভাষা একই মাগধী প্রাকৃত থেকে বিকশিত। ‘মগ’ নামীয় লোকেরা উত্তর বার্মার প্রায় জনবিরল পার্বত্য অঞ্চলে শুধু বসতি নয়, নিজেদের স্বাধীন রাজ্য ও প্রতিষ্ঠিত করে। এটা ছিল খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর ঘটনা।

ঠিক এই সময়ে পূর্ব ভারত ও দূর প্রাচ্যে ব্যবসা করতে আসা কিছু আরব ব্যবসায়ী ও তাদের কর্মচারিরা জাহাজ ভঙ্গের কারণে চট্টগ্রাম ও আরাকান এলাকায় স্থায়ী বসতি স্থাপন করে।’

এই আসা-যাওয়ার প্রাক্কালে এবং স্থায়ী বসতি করার সিদ্বান্তের কারণে পূর্ব ভারতীয় বাঙালি অনার্য-প্রাকৃতজনের সঙ্গে আরবীয় সেমেটিক মানুষের একটি সামজিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তখন আরবে মুহম্মদ (সঃ) ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন।

আরবের মানুষ দলে দলে ধর্মপ্রচার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন তারা গৌড়েও চলে আসে। গৌড়ে তাদের আসা এতোটা সহজ ছিল না, যদি শশাঙ্ক বা লক্ষণ সেনের সামন্ত, মহাসামন্ত, ছোট সামন্তরা বৌদ্ধ প্রাকৃতজনদের নির্বিচারে নির্মূলের নির্যাতন না করতেন, তহলে ইতিহাস লেখা হত অন্যভবে।

ইতিহাস এই সময় এসে বাঁক নেয় মানুষের ইতিহাসে, শশাঙ্ক উত্তর গতিপথে, গৌড় বঙ্গ ইতিহাসে তার পূর্বাপর্ব শেষ করে লক্ষণসেনের সময় এসে ঝিমুতে থাকে। এই ঝিমানোভাব কেটে গৌড় বঙ্গের যে যাত্রা সূচিত হয় তাই প্রদোষে প্রাকৃতজনের ইতিহাস।

হাজার বছরের ব্যবধানে যে ইতিহাস আমরা ভুলতে বসেছিলাম। শওকত আলী কতোটা মর্মভেদী চোখে আমাদের ইতিহাসের গতিপথে নিয়ে যান তা বিস্মিত করে যেকোনো সচেতন পাঠককে। বঙ্গদেশ কেমন জীবন্ত ও ব্যক্ত হয়ে উঠেছে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসটি না পড়লে কেউ সহজে বুঝে উঠতে পারবে না।

গৌড় বা বঙ্গ সভ্যতার কতোটা উন্নত পর্বে নিয়ে গিয়েছিল তা জেনে অবাক হতে হয়, তখনও পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতা জেগেই উঠে নাই। বৌদ্ধ-সমাজ উৎকর্ষের কোথায় গিয়ে পড়েছিলো তা আমরা দেখি প্রদোষে প্রাকৃতজনের প্রতিটি লাইনে লাইনে।

গৌড়ীয় বঙ্গ তখন স্থাপত্য, ভাস্কর্য, পটচিত্র, গান, নৃত্যকলায় একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। ধর্মীয় নান বিধি-নিষেধের কারণে সেই শিল্পচর্চাও বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। ক্রমাগত নির্যাতনে প্রাকৃতজনের সেই গণঐতিহ্য ধ্বংস হয়ে পড়ে।

ধ্বংস ও নতুনকে ইতিহাসের উত্তররৈবিক শোভাযাত্রার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে শওকত আলী আমাদের পথ দেখালেন সত্য-মহত্ত্বের অনাবাদী ইতিহাসের ভূমিসত্তায় সিক্ত জনপদের। ফলে, আমরা গৌড়ীয় বঙ্গের ইতিহাসে শোভাযাত্রা সূচিত হতে দেখি রক্ত ও আগুনের নদী বেয়ে।

আমরা জানি যে উপন্যাস একটি বুর্জোয়া রূপকল্প, তার ভাষা, আবেদন, পাঠককে মনোরঞ্জন করবে, পাঠক আবেগে আপ্লুত হবে, ভাবে মরে যাবে। প্রকাশকের লগ্নী টাকা ওঠে যাবে। ইউরোপীয় উপন্যাসের গতিপথের দিকে তাকালে আমরা পষ্ট বুঝতে পারি, উপন্যাস একটি ইউরোপীয় ডিসকোর্স।

যা দিয়ে তারা তাদের ভাষায় অপর পৃথিবীর মানুষের মনোভুবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে। যে কারণে আধুনিক উপন্যাসের শুরু থেকেই আমরা দেখি উপন্যাস- একটি বুর্জোয়া রূপকল্প। তা হলেও উপন্যাস আমাদের মতো দেশে কখনও তার মেজাজ নিয়ে বুর্জোয়াদের তৈরি করা পথে হাঁটেনি।

আমাদের এখানে উপন্যাস বারবার বঞ্চিত মানুষের মুখে ভাষা দিতে চেয়েছে, তাদের কথা বলতে চেয়েছে। ইতিহাসের সত্যকে টেনে তুলতে চেয়েছে। আধুনিক কথাসাহিত্যে জনক গোগলের ‘ওভারকোট’ গল্পটি সেক্ষেত্রে আমাদের জন্য বড় প্রমাণ।

গোগল দেখান, যে সামন্তীয় নিস্পেষণ থেকে বেরিয়ে একটি সমাজ যখন পুঁজির নানান বাঁকে অংশগ্রহণ করেছে তখন মানুষের অসহায়ত্ব কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে । বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া সমাজে কিভাবে দ্বন্দ শুরু হয়। কথাসাহিত্যের ইতিহাস মানুষকে জাগিয়ে দিয়েছে ব্যাপকভাবে, আর বুর্জোয়া ব্যক্তি স্বাধীনতার পৃথিবীতে মানুষ কতটা অসহায় হয়ে পড়ে।

শওকত আলী ইতিহাসের হাজার বছরের গতিপথের দিকে আমাদের ফিরিয়ে নেন এবং বাঙালি জাতিসত্তাকে সনাক্ত করেন। ১৮ শতকের বাংলা কথাসাহিত্যের যে অর্জন বঙ্কিম থেকে শুরু করে শওকত আলী পর্যন্ত তা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।

উপন্যাসের ধারাবাহিকতার মাধ্যমে বঙ্কিম যে মনোভূমি রচনা করতে চেয়েছিলেন ভারতবর্ষে, তার চেয়ে মহৎ চোখে শওকত আলী নির্মাণ করেন তার গণভাষা-প্রাকৃতজনের মুখের ভাষা।

ইতিহাসকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে টেনে নেওয়ার যে একটি ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল; প্রদোষে প্রাকৃতজনের মধ্য দিয়ে শওকত আলী বাঙালির ইতিহাসকে বাঁচিয়ে দেন। মানুষ ও ইতিহাসের মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে ইতিহাসে তার স্থান তাই নির্ধারিত হয়ে আছে।

যে কারণে আমারা তাকে প্রদোষে প্রকৃতজনের কবি বলে অভিহিত করেছি। প্রদোষ কেটে যাওয়ার যে তাড়না প্রাকৃতজনের মধ্যে জেগেছে তাকে শনাক্ত করে, বাঙালির প্রত্যুষকে তিনি নতুন করে গণবাঙালির চেতনায় উন্মেষ ঘটিয়ে দেন। এখানে শওকত আলীর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *