পাওলো কোয়েলহো; দি অ্যালকেমিস্ট;  স্বপ্ন জয়ের গল্প

রাজিক হাসান

তিনি বই বিক্রির সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়ে স্থান করে নিয়েছেন গিনেস ওয়ার্ল্ড বুকে। সেই ছোট্ট বেলায় স্কুলে পড়ার সময় বলতেন—মা, আমি লেখক হতে চাই। ছেলের এই আগ্রহের কথা শুনে তাঁর মা বলতেন, ‘বাবা, তোমার পিতা একজন বিখ্যাত প্রকৌশলী। তোমার বাবা বুঝেশুনেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানের পেশা গ্রহণ করেছেন। কারণ, তিনি কী চান, তা তিনি জানতেন। তুমি কি সত্যিই জানো লেখক হওয়ার অর্থ কী?

মা-বাবার মতে ছোটবেলা থেকেই তাঁর আচরণে অস্বাভাবিকতা ছিল। মাত্র ষোল বছর বয়সে অস্বাভাবিক আচরণ প্রকটভাবে ধরা পড়ে পাওলো কোয়েলহো’র।  তখন তাঁকে মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়। সুযোগ বুঝে একবার, দু’বার নয়, তিন তিনবার পলায়ন করেন সেই চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে। চার বছর পর তাঁর বয়স যখন বিশ সেখান থেকে মুক্তি পান তিনি।

এরপর বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বাধ্য হয়ে তিনি আইন কলেজে ভর্তি হন। কবর দেন লেখক হওয়ার স্বপ্নকে। কিন্তু এক বছর পর তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন। ভবঘুরে জীবনকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে দক্ষিণ আফ্রিকা, ম্যাক্সিকো ও ইউরোপে ঘুরে বেড়ান তিনি।

পরের দিনগুলোতে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন পাওলো কোয়েলহো। এরপর তিনি মাতৃভূমি ব্রাজিলে ফিরে আসেন। শুরু করেন গান লেখা। রাউল সেক্সেনার গাওয়া গানগুলো ব্রাজিলজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

সরকারবিরোধী গান লেখা ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ১৯৭৪ সালে তাঁকে গ্রেফতার করে তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক। নিষিদ্ধ হয় তাঁর লেখা গানগুলো। এরপর তিনি শুরু করেন জীবনঘনিষ্ঠ গল্প লেখা।

তাঁর স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার।  এ কারণে তিনি গীতিকবিতা লেখার মতো লাতিন আমেরিকার লাভজনক পেশা ছেড়ে একজন লেখক হতে চেষ্টা করেন। ১৯৮২ সালে তাঁর প্রথম বই ‘হেল আর্কাইভস’ প্রকাশিত হয়। তাঁর ‘প্র্যাকটিক্যাল ম্যানুয়েল অব ভ্যামপারিজম’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে।

‘সান্তিয়াগো দে কম্পোসতেলা’ রচনার পর রচনা করেন ‘দ্যা পিলগ্রিমেজ’ ও ‘দি অ্যালকেমিস্ট’। দ্যা অ্যালকেমিস্ট উপন্যাসটির প্রকাশক বইটির মাত্র ৯ শত কপি প্রকাশ করে। কিছুদিন পর অন্য এক বড় প্রকাশনা সংস্থা ‘দ্যা অ্যালকেমিস্ট’ পুনঃর্মুদ্রণ করে। দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়  ৬৫ মিলিয়নেরও বেশি।

বইটি অনূদিত হয় বিশ্বের আশিটিরও বেশি ভাষায়। এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ১৫০ মিলিয়ন কপি। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান করে নেয় বইটি। তাঁর গল্প বা উপন্যাস কেন পাঠকের কছে এতটা সমাদৃত তা সত্যিই রহস্যের বিষয়। 

পাওলো কোয়েলহো এক সাক্ষাৎকারে বলেন ‘অবশ্যই তোমাকে জীবনে ঝুঁকি নিতে হবে। কারণ তুমি তোমার জীবনে অসাধারণ কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তখনই হবে, যখন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় ঘটতে দেখবে।’ ‘তুমি তোমার স্বপ্নকে সবসময় স্মরণ করবে। শুধুমাত্র স্বপ্নের জন্যই যুদ্ধ করবে আজীবন।

তুমি নিশ্চয় জানো, জীবনের কাছে তুমি কী চাও? , ‘জীবনে অনেক বিপর্যয় দেখেছি। বিপর্যয়ের ঝড়ে কখনো হতবাক হয়েছি। এ কারণে শিখেছি আসলে জীবনকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। তার চেয়ে বরং ধৈর্য নামের শিল্পচর্চা শেখা উচিত। শেখা উচিত; প্রকৃতির এই উন্মাদনাকে সম্মান করা।

আমরা অদৃষ্টকে বদলাতে পারি, কিন্তু কখনো নিয়তিকে বদলাতে পারি না। অদৃষ্ট অর্থ রাস্তার বাম বা ডান পাশে চলতে পারা। যদিও আগেই রাস্তার কোন পথে চলতে হবে নির্ধারণ করে দেয়। আমাদের সবারই আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত— কীভাবে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাধ্যমে অদৃষ্টকে বদলাতে পারি।

তার লেখা মানুষের হৃদয়ে আঘাত করার কারণ কী—বিভিন্ন সময় সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছেন। এর উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার হৃদয় দিয়ে লিখি। আর এ কারণে সমালোচকরা আমার সমালোচনা করতে পারে না। যদি লেখায় আমার হৃদয় না থাকে, অথবা অন্য কারোর মতো ভণিতা করে বলতে চাই, ঠিক তখনই পৃথিবীর ভারসাম্যহীন আচরণের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু আমি নিজেকে ভালো করেই চিনি। বিপদের ভয় বিপদে পড়ার দুর্গতির চেয়েও ভয়ঙ্কর বিষয়। প্রত্যেক হৃদয়কেই ক্ষতবিক্ষত হতে হয় যখন তার স্বপ্ন সে বাস্তবায়ন করতে যায়।’

তাঁর প্রেম বিষয়ক ভাবনাটি সত্যি অনন্য। তাঁর মতে, প্রেম স্বাধীন এবং তা নিজের ইচ্ছায় চলে। অন্যের ইচ্ছার ধার ধারে না। সকল প্রেমিক-প্রেমিকাই তা জানে কিন্তু তা স্বীকার করে না। তারা ভাবে বিনয়, ক্ষমতা, সৌন্দর্য, সম্পদ, অশ্রু এবং হাসির মাধ্যমে প্রেমকে তারা প্রলুব্ধ করতে পারে। প্রকৃত অর্থে প্রেমই মানুষকে প্রলুব্ধ করে। মানুষ কখনও প্রেমকে প্রলুব্ধ করতে পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *