“দ্যা ব্যাটল অফ রামু” ভয়াভয় যুদ্ধের ইতিহাস

শিরুপন বড়ুয়া

এইতো সেদিনের কথা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে মিয়ানমার সরকার তাদের দেশের একটি জনসংখ্যা গণনা বিষয়ক মানচিত্রে বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপকে সে দেশের অংশ হিসেবে দেখায়। পরে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ডেকে পাঠিয়ে এর প্রতিবাদ করলে মিয়ানমার তাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চায়।

কিছুদিন পরে তারা আবারো একই কাজ করে ক্ষমা চায়। মিয়ানমারের এই অভ্যাস কিন্তু আজকের নয়, বরং অনেক পুরনো অভ্যাস। ১৮২৩ সালেও তারা একবার শাহপরীর দ্বীপকে তাদের সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাবি করে বসে।

সেবার অবশ্য সেই ভুলের জন্য গোটা দেশটাকেই তারা হারিয়ে ছিলো ব্রিটিশদের হাতে। আর এসব কিছুর সূচনা হয়েছিলো আমাদের কক্সবাজার জেলার রম্যভূমি রামু উপজেলা থেকে। ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা বোধপায়া স্বাধীন আরাকান দখল করে নেন। মূলত এরপর থেকেই ব্রিটিশদের কাছে রামু কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আরাকান থেকে দলে দলে শরণার্থীরা আসতে শুরু করে রামুতে। Sir John Malcolm এর “The Political History of India, from 1784 to 1823, Volume 1” এ শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য ক্যাপ্টেন কক্সের কর্ম পদ্ধতির কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। শরণার্থীদের পুনর্বাসন করতে ১৭৯৯ সালের ১৩ই জুলাই ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স রামুতে আসেন।

তিনি শরণার্থী পুনর্বাসন সংক্রান্ত তাঁর রিপোর্টে বর্তমানের কক্সবাজারকে বেছে নেওয়ার জন্য ৫ টি কারণ উল্লেখ করেন। তার মধ্যে একটি হলো, এই এলাকাটি রামু নদীর (বাঁকখালি) মোহনা থেকে নাফ নদীর মোহনা পর্যন্ত পাহাড়ি জঙ্গলে পূর্ণ বিস্তৃর্ণ পরিত্যাক্ত ভূমি।

যা দখল করতে ক্ষতিপূরণ বাবদ বেশি অর্থ খরচ হবে না। তাছাড়া একদিকে সাগর এবং দুই দিকে দুটি নদী থাকায় আরাকানী উদ্বাস্তুদের জীবন-জীবিকা অনেকটাই সহজ হবে। কেননা তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো জেলে পরিবার। ক্যাপ্টেন কক্স শরণার্থী বিষয়ে যা কিছু করেছেন রামুতে বসেই করেছেন ।

তবে শরণার্থীদের পাশাপাশি আরাকানের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারাও আশ্রয় নেয় দক্ষিণ চট্রগ্রামের হারবাং, রামু, উখিয়া এবং টেকনাফের ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ে। এসব স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের নেতা ছিলেন চিন পিয়ান। এছাড়াও ব্রিটিশ শাসনাধীনের বাইরে থাকা বর্তমান ভারতের আসাম এবং মরিপুরী রাজ্যও বর্মীরা দখল করে নেয়। মনিপুরের রাজকুমারকেও ব্রিটিশরা বাংলা প্রদেশে আশ্রয় দেয়।

স্বাভাবিকভাবেই বর্মী রাজার পক্ষ থেকে এসমস্ত রাজ্যের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের গায়ে বিদ্রোহীর তকমা লাগানো হয়। আর এই বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ শাসনাধীন এলাকায় আশ্রয় নেয়াতে ব্রিটিশদের সাথে বর্মীদের সস্পর্কের অবনতি হতে থাকে।

সম্পর্ক উন্নতি করার লক্ষ্যে ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন স্যামস এবং ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে বার্মার আভাতে বর্মী রাজার দরবারে পাঠানো হলেও উল্লেখযোগ্য কোন সফলতা আসেনি। বরং বর্মী রাজা বোধপায়া সহ তাঁর উত্তরসূরিরা প্রতিনিয়ত বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেয়ার কারণে বাংলার চট্রগ্রাম আক্রমণের হুমকি দিয়ে আসছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে।

এরই ধারাবাহিকতায় বর্মী রাজা নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত (বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ) শাহপরীর দ্বীপ নিজেদের রাজ্যের অংশ বলে দাবি করতে থাকে। তাদের যুক্তি ছিলো প্রাচীন কাল থেকে দক্ষিণ চট্রগ্রামের এলাকাগুলো আরাকানের অধীনে ছিলো।

তাই শাহপরীর দ্বীপতো বটেই, এমনকি রামু পর্যন্ত বর্মী রাজা দাবি করে বসেন। কিন্তু বর্মীরা আরাকান দখলের আগেই নাফ নদীর এপারের টেকনাফ থেকে চট্রগ্রাম পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। তাই বর্মীদের এই যুক্তিকে ব্রিটিশরা খুব একটা পাত্তা দিতো না।

কিন্তু বর্মীরাও যে সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। ১৮২৩ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বর্মী রাজার আদেশে আরাকান থেকে পাঠানো এক হাজার সৈন্য হামলা চালিয়ে ব্রিটিশ চেকপোস্ট ধ্বংস করে শাহপরীর দ্বীপ দখল করে নেয়। এতে তিনজন ইংরেজ সৈনিকসহ বেশ কয়েকজন দেশীয় সৈনিক মারা যায়।

এদিকে ব্রিটিশরা বসে ছিলো না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত সুরক্ষার জন্য কর্ণেল শেইপল্যান্ডের অধীনে “চট্রগ্রাম ডিভিশন” গঠন করা হয়। সেই ডিভিশন থেকে ছোট একটা সৈন্যদল ইংরেজ ক্যাপ্টেন নটনের নেতৃত্বে পাঠিয়ে দেয়া হয় রামুতে।

ক্যাপ্টেন নটনের সেই দলে ছিলো ৩৫০ জন পদাতিক সৈন্য, ২টি সিক্স পাউন্ডার গান (কামান), কিছু অশ্বারোহী সৈন্য, চার শত ভাড়াটে মগ সৈন্য এবং ২৫০ প্রাদেশিক সৈন্য। কিছু ঐতিহাসিক ব্যক্তি মনে করেন ক্যাপ্টেন নটনকে এত কম সৈন্য এবং গোলাবারুদ দিয়ে রামুতে পাঠানোটা শুধু বোকামিই নয়, অপরাধও বটে। কারন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র হাতে যথেষ্ট তথ্য ছিলো যে, বর্মী রাজার সেনাপ্রধান মহা বান্ডুলা দশ হাজার সৈন্য নিয়ে রামু আক্রমণ করতে রওনা হয়েছেন।

এটা জানার পরও মহা বান্ডুলা’র মতো একজন সাহসী এবং বিচক্ষণ সেনাপ্রধানকে তুচ্ছজ্ঞান করার দুঃসাহস দেখানোটা বোকামিই বটে। এমনকি Horace Hayman Wilson এর “The History of British India” বই থেকে এটাও জানা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র নাকি ধারণা ছিলো এই সৈন্যসহ পরবর্তীতে রামুতে Captain Noton এর সাথে যোগ দেওয়া Captain Trueman এর আরো ৬৫০ জন প্রাদেশিক সৈন্য নিয়ে চাইলে আরাকানও দখল করা যায়। সময়টা ১৮২৪ সাল।

বর্মীরাজ বাগিদোর নির্দেশে তাঁর সেনাপ্রধান মহা বান্ডুলা দশহাজার সৈন্য নিয়ে প্রথমে আরাকানে আসেন। সেখান থেকে চার জন আরাকানী রাজাকে আট হাজার সৈন্য নিয়ে নাফ নদী পার করে রামু আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। এই হামলার নেতৃত্ব দেন সেনাপতি মায়াওয়াদি মিঙ্গী উ সা।

ইনি আবার সাহিত্য রচনায় বেশ দক্ষ ছিলেন। এখনো তাঁকে একজন গুরুত্বপূর্ণ বার্মিজ সাহিত্যিক হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্মীরা প্রথমে নাফ নদী পার করে অনেকটা বিনা বাঁধায় টেকনাফ দখল করে। ৯ই মে তাঁরা উখিয়ার রত্নাপালং দখল করে নেয়। বর্মীদের বাঁধা দিতে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি রামু থেকে এগিয়ে যান ক্যাপ্টেন নটন।

কিন্তু হাতির মাহুতদের অদক্ষতা এবং তাঁর মূল বাহিনীর পেছনে থাকা কামানের বহরটি ঠিক সময়ে তাঁর সাথে যোগ দিতে না পারায় তিনি রত্নাপালং থেকে পিছু হটতে বাধ্য হন। কেননা কামানের ব্যবহার ছাড়া বর্মীদের আটকানো অসম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

তাছাড়া ঐ এলাকায় বর্মীরা আগে থেকেই রাস্তার দুপাশের পাহাড়ে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়েছিলো। যেখান থেকে বেশ আরামে বসেই ইংরেজ সৈন্যদের বেছে বেছে গুলি করা যায়।

এছাড়াও ক্যাপ্টেন নটন বর্মীদের সাথে মূল যুদ্ধটা রত্নাপালং-এ না করে রামুতে করার পরিকল্পনা করেন। কারণ বর্মীরা রামু পর্যন্ত আসার আগেই চট্রগ্রাম থেকে ব্রিটিশ বাহিনীর আরো বিপুল সংখ্যক সৈন্য গোলাবারুদসহ রামুতে তাঁর সাথে যোগ দেয়ার কথা ছিলো। আর তাই সবদিক বিবেচনা করে রামুকেই তিনি প্রাধান্য দেন মূল যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে।

রামুতে ফিরে ১১ই মে তিনি রত্নাপালং এ ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ পাঠিয়ে চট্রগ্রামের তাঁর মূল ব্রিগেডের মেজরকে সতর্ক করে দেন। ক্যাপ্টেন নটনের সেই বিবরণ থেকে জানা যায়, রত্নাপালং এর ঘটনায় ব্রিটিশ অফিসার বেনেট বাম হাতে আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং অন্য এক অফিসার ক্যাম্পবেল ডান পায়ের গোড়ালিতে সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত হন।

সেই সাথে ব্রিটিশদের মোট সাতটি হাতি মারা যায়, ১১ টি হাতি আহত হয়। এদিকে ১১ই মে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ট্রুম্যান তাঁর ৬৫০ জন প্রাদেশিক সৈন্য নিয়ে রামুতে ক্যাপ্টেন নটনের সাথে যোগ দেন। ১৩ই মে আট হাজার বর্মী সৈন্যসহ সেনাপতি মায়াওয়াদি মিঙ্গী উ সা রত্নাপালং থেকে রামু’র উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে বাঁকখালি নদীর দক্ষিণ পাড়ের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নেয়।

সেদিন সন্ধ্যায় ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন ট্রুম্যান দুইটি সিক্স পাউন্ডার কামানসহ তাঁর দলবল নিয়ে নদীর উত্তর পাড় থেকে অপর পাড়ের বর্মীশিবিরে গোলাবর্ষণ করতে থাকেন। স্থানটি যে আজকের রামকোট ছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই। ক্যাপ্টেন নটনের উদ্দেশ্যে ছিলো চট্রগ্রাম থেকে কোম্পানি’র আরো সৈন্য না আসা পর্যন্ত বর্মীদের রামকোট এলাকাতেই আটকে রাখা।

The Quarterly Oriental Magazine: Review & Register, Volume ২ এর পৃষ্টা নম্বর ৪১ এ বর্মী সৈন্যদের বাঁকখালি পার করার একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৪ই মে সন্ধ্যায় বর্মী সৈন্যরা বাঁকখালি পার করার চেষ্টা করে কিন্তু ব্রিটিশদের সিক্স পাউন্ডার কামানের গোলাবর্ষণে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু রাত নামতেই ব্রিটিশ সৈন্যরা দেখতে পেলো নদীর দক্ষিণ পাড়ের গ্রামের ঘরগুলো সব আগুনে জ্বলছে।

যে গ্রামের কথা এখানে বলা হচ্ছে তা যে বর্তমানে দক্ষিণ রাজারকুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৫ই মে ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই বর্মী সৈন্যরা নীরবে পূর্ব দিকে সরে গিয়ে বাঁকখালী নদী পার হয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের ২৩০ গজের মধ্যে চলে আসে। শত্রুদের আচমকা সামনে পেয়ে ক্যাপ্টেন ট্রুম্যান তাঁর দলবল নিয়ে আগের দুটি সিক্স পাউন্ডার কামানের মুখ পূর্ব দিকে ঘুরিয়ে গোলা বর্ষণ করতে থাকেন।

কিন্তু বাঁকখালি নদীর খাড়া পাড়কে ঢাল বানিয়ে এমনভাবে বর্মীরা শুয়ে থাকে যাতে কামানের বেশিরভাগ গোলা নদীর পানিতে এবং অপর পাড়ে গিয়ে পড়তে লাগলো। বইয়ের বিবরণ পড়ে এটা বুঝতে কষ্ট হয়না বর্মীরা দক্ষিণ রাজারকুলের মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে ব্রিটিশদের সেদিকে ব্যস্ত রেখে সৈন্যদলের একটি অংশ পূর্ব রাজারকুলের কাছাকাছি গিয়ে নদী পার করে ব্রিটিশদের ক্যাম্পের সামনে চলে আসে।

প্রায় একই ধরনের বিবরণ Horace Hayman Wilson এর অপর একটি বই “Narrative of the Burmeses War, in 1824-25 ” এর পৃষ্ঠা নম্বর ৫৪ তেও পাওয়া যায়।

১৫ই মে। এদিন বাঁকখালি নদীর উত্তর পাড়ে থাকা ব্রিটিশ সৈন্যদের অবস্থান দাঁড়ায় অনেকটা এরকম, ক্যাপ্টেন ট্রুম্যান ২টি সিক্স পাউন্ডার কামান নিয়ে পূর্ব দিকে শত্রুদের অবস্থান লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করতে থাকেন, তাঁর ঠিক পেছনে ক্যাপ্টেন নটন তাঁর রিগুলার পদাতিক বাহিনী নিয়ে অবস্থান নেন।

ক্যাপ্টেন নটনের ডান পাশে ছিলো গভীর পরিখা এবং তারও দক্ষিণে বাঁকখালি নদী, আর বাম পাশে উত্তর দিকের উচু বাঁধের মত জায়গায় বর্তমানে অফিসেরচরমুখী হয়ে অবস্থান নেয় ৪০০ শত ভাড়াটে মগ সৈন্য এবং ২৫০ শত প্রাদেশিক সৈন্য।

যেহেতু ভাড়াটে মগ সৈন্য এবং প্রাদেশিক সৈন্যরা কম দক্ষ এবং অনিয়মিত বাহিনী ছিলো, তাই ক্যাপ্টেন নটন তাদেরকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দিকটায় অবস্থানের নির্দেশ দেন। তাছাড়া একই দিনে ক্যাপ্টেন নটন খবর পান যে, চট্রগ্রাম থেকে ২৩ ডিভিশনের নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি অর্থাৎ ২৩ পদাতিক ডিভিশন নিয়ে ক্যাপ্টেন ব্র্যানডন রামু’র উদ্দেশ্যে ১৩ই মে রওনা দিয়েছেন এবং ১৬ই মে সন্ধ্যার মধ্যে তারা রামুতে পৌঁছে যাবে। তাই ক্যাপ্টেন নটনের এটা বিশ্বাস না করার কোন কারণ ছিলো না যে, যুদ্ধটা তাঁরাই জিততে যাচ্ছেন।

তাঁর অধীনে থাকা ব্রিটিশ অফিসাররা একে একে আহত হতে থাকলেও তিনি তারপরের দিন অর্থাৎ ১৬ই মে সন্ধ্যা পর্যন্ত বর্তমান অবস্থান ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেন। এই দিন ভাড়াটে মগ সৈন্যদের নেতৃত্বে থাকা ব্রিটিশ অফিসার প্রিঙ্গল এবং পদাতিক বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা ব্রিটিশ অফিসার বেনেট আবারো আহত হন।
১৬ই মে।

ক্যাপ্টেন নটন সারাদিন অপেক্ষা করে গেলেন চট্রগ্রাম থেকে রওনা হওয়া ক্যাপ্টেন ব্র্যানডন এবং তাঁর ২৩ পদাতিক ডিভিশনের আশায়। এমনকি সন্ধ্যা পেরিয়ে একসময় রাত নামলো চট্রগ্রামের ২৩ পদাতিক ডিভিশন রামু পৌঁছালো না। তবে এইদিন উল্লখযোগ্য কোন ঘটনা ঘটেনি শুধু সারাদিনের দুপক্ষের গোলাগুলি ছাড়া।
১৭ই মে। সকাল হতেই বর্মীদের আক্রমণ তীব্র হতে থাকে।

কারণ ততক্ষণে তারাও জেনে যায় ব্রিটিশদের সাহায্য করতে কোন সৈন্যবাহিনী রামুতে আসছে না। এছাড়া এইদিন তাদের প্রধান সেনাপ্রধান মহা বান্ডুলা আরাকান থেকে রামু’র উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এতে বর্মী সৈন্যদের মনোবল আগের চেয়ে বেড়ে যায়। সকাল ৯টার দিকে বাম দিকের ভাড়াটে মগ ও প্রাদেশিক সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। সাথে সাথে বর্মীরা সে জায়গাটা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।

অর্থাৎ উত্তরদিকে বর্তমান অফিসের চর বা লামার পাড়া থেকে শুরু করে পূর্ব দিকে পূর্ব রাজারকুল পর্যন্ত অর্ধ চন্দ্রের মতো করে বর্মীরা ক্যাপ্টেন নটনদের ঘিরে ফেলে। দক্ষিণ দিকে নদী পার হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না, কারণ সেখানে বর্মীদের বাকি সৈন্যরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলো। ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই, একমাত্র পশ্চিম দিক ছাড়া তিনদিক থেকে বর্মীরা ব্রিটিশদের ঘিরে ফেলে।

নটনের সামনে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা ছাড়া আর কোন উপায় রইলো না। ক্যাপ্টেন ট্রুম্যান তাঁর অবস্থান থেকে কামান পেছনে ফেলে পিছু হটতে বাধ্য হন। সাথে সাথেই সব শেষ হয়ে যায়। বীরত্বের সাথে অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে আট হাজার বর্মী সৈন্যের সঙ্গে কয়েকদিন লড়াই করেও ব্রিটিশরা রামু যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে হেরে যায়।

পলায়নরত অবস্থায় ক্যাপ্টেন নটন, ক্যাপ্টেন ট্রুম্যান, অফিসার প্রিঙ্গল, লেফটেনেন্ট গ্রিগ, অফিসার বেনেট এবং এসিসট্যান্ট সার্জন মেইসমোরসহ দুইজন ভারতীয় অফিসার মারা যান। লেফটেনেন্ট স্কট, লেফটেনেন্ট ক্যাম্পবেল আহত অবস্থায় এবং অফিসার কডরিংটন চট্রগ্রামে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

ব্রিটিশদের বেশ কিছু সৈন্যকে বার্মার আভাতে বর্মী রাজার দরবারে বন্দী হিসেবে নেওয়া হয়। বার্মিজ সৈন্যদের হালকাভাবে নেওয়ার ফল ভোগ করে ব্রিটিশরা। এতবেশি ব্রিটিশ অফিসার ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধেও মারা যায়নি।

বর্মী সৈন্যরা যেভাবে ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যা করেছিলো তার কিছু বর্ণনা The Quarterly Oriental Magazine: Review and Register, Volume 2, September & December এর ২৬ নং পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়। ক্যাপ্টেন নটনকে পলায়নরত অবস্থায় বর্মী সৈন্যরা ঘিরে ফেলে। তাদের মধ্যে একজন মাসকটের (এক ধরনের বন্দুক) গুলিতে নটনকে প্রথমে আহত করে মাটিতে ফেলে দেয়।

পরে সেই সৈন্যটিই নটনকে তলোয়ার দিয়ে কয়েক টুকরো করে কেটে হত্যা করে। তার হাত পা নাকি আভাতে বর্মীরাজের দরবারে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন ট্রুম্যানকে এক অশ্বারোহী সৈন্য একইভাবে প্রথমে আহত করে পরে হাত পা কেটে টুকরো টুকরো করে হত্যা করে। অফিসার প্রিঙ্গল এবং বেনেট বাঁকখালি সাঁতরে পালাতে গিয়ে শত্রুদের হাতে মারা যান।

অবশ্য যে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা বাংলার নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ব্ল্যাক হোল থিউরি’র মতো অবাস্তব গল্প সাজাতে পারে তারা এখানেও যে অতিরঞ্জিত কিছু বলেনি তা বিশ্বাস করা কঠিন। ক্যাপ্টেন ব্র্যানডনের নেতৃত্বে ২৩ পদাতিক ডিভিশন চট্রগ্রাম থেকে আসার পথে বৃষ্টি তাদের চলার গতিকে মন্থর করে দেয়। কিন্তু এরই মধ্যে রামুতে ইংরেজরা পরাজিত হওয়াতে তারা জুনের প্রথম দিকে চট্রগ্রামেই ফিরে যায়।

এই যুদ্ধে বর্মী সেনাপতি মায়াওয়াদি মিঙ্গী উ সা বেশ বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। তিনি তাঁর বাহিনীকে দ্রæততার সাথে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতেন এবং তিনি তা করতেন রাতের বেলা। যার কারণে ব্রিটিশদের অনেক বেগ পেতে হয় বার্মিজ সৈন্যদের গতিপ্রকৃতি বুঝতে।

১৭ই মে রামুতে ব্রিটিশদের পরাজয়ের পর বর্মী রাজার সেনাপ্রধান মহা বান্ডুলা রামুতে আসেন। সেনাপতি মায়াওয়াদি মিঙ্গী উ সা তাঁকে চট্রগ্রামের অভিমুখে যাত্রা করার অনুরোধ করলে বান্ডুলা তা নাকচ করে দেন। অথচ ব্রিটিশ ঐতিহাসিকেরা এখনো মনে করেন, যদি মহা বান্ডুলা চট্রগ্রাম দখলের চেষ্টা করতেন তবে তিনি তাতেও সফল হতেন। যদিও বান্ডুলা চট্রগ্রামে না গিয়ে কক্সবাজার থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে অভিযান চালান।

“ব্যাটল অব রামু” খুব বড় মাপের যুদ্ধ না হলেও এর ফলাফল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। এই যুদ্ধের ফলাফল ব্রিটিশদের আভিজাত্যে আঘাত করে। বার্মিজ এম্পায়ার হয়ে উঠে ব্রিটিশদের নতুন মাথা ব্যাথা।

রামু যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ব্রিটিশরা বার্মিজদের সাথে “প্রথম এ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধে” জড়িয়ে পড়ে। বার্মিজরা এই যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে হেরে যায়। পর পর আরো দুটি এ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধে হারার পর বার্মিজরা ব্রিটিশদের হাতে তাদের স্বাধীনতা হারায়।

তথ্যসূত্র:

BBC bangla news

The Political History of India, from 1784 to 1823, Volume 1

The Asiatic Journal & Monthly Register, Vol.19,London, 1825,p.221

The Annual Register of World Events: A Review of the Year 1824, Volume 66, edited by Edmund Burke, p.121

Captain Pogson’s narrative during a tour to Chateegaon, By Wredenhall Robert Pogson,1831,p.126

The History of British India, Vol.3,By Horace Hayman Wilson,p. 40, 41

The quarterly oriental magazine: review and register, Volume 2, September & December, p.24

Narrative of the Burmeses War, in 1824-25, Horace Hayman Wilson,p.56, 57

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *