তাহলে চলো তুমি আর আমি –আমরা দুজনে মিলে বেরিয়ে পড়ি। চলো যাই সেই দেশে, যেখানে কিনা মনের কথা আবিষ্কার করবার আশায় বৈজ্ঞানিকেরা হাজারো রকমের তোড়জোড় করেছেন। ওদের কায়দাকানুনগুলো একবার দেখে না এলে খেয়ালই হবে না সমস্যাটা কি দারুণ গুরুতর!
সে কিন্তু অনেক দূরপাল্লার পথ। তবে বিজ্ঞানের দৌলতে আমরা তো আর দূরপাল্লাকে সত্যিই বড়ো একটা পরোয়া করিনে। তাই চলো দুজনে মিলে এক উড়োজাহাজে চেপে বসা যাক আর তারপর মেঘেদের অবাক করে দিয়ে চলে যাই সেই অনেক দূরের দেশে।
উড়োজাহাজ থেকে নেমে প্রথমটায় আমরা কিন্তু একটুখানি বেকায়দায় পড়বো। কেননা আমাদের ভাষা ওরা বুঝবে না, ওদের ভাষাও আমরা বুঝবো না। তাই তুমি হয়তো ফিসফিস করে আমায় শুধোবে, এ আবার কোন আজব শহরে নিয়ে এলন মশায়?
শহরটার নাম আগে তো ছিল সেন্ট পিটার্সবার্গ! তারপর নামটা পালটে গিয়েছে। আজকালকার ভূগোলে ওর নাম হয়েছে লেনিনগ্রাড।
কিন্তু থেকে থেকে এই শহরে কেন? কেননা মনের কথা নিয়ে যে- বৈজ্ঞানিক সবচেয়ে আশ্চর্য আবিষ্কার করেছেন তাঁর পরীক্ষার ঘাঁটি যে ছিল এই শহরেই। ল্যাবরেটরিটা তৈরি হবার সময় খুঁটিনাটি হিসেব পর্যন্ত তিনি নিজে এঁকে দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে ও-রকম ল্যবরেটরি ওই প্রথম। ওইটে দেখবার জন্যেই তো আমরা হাজির হলাম এতদূরের এই শহরে।
তাই চলো এখানের অ্যাপটিকারস্কি বলে যে ছোট্ট দ্বীপ তারই এক নির্জন পথ ধরে দুজনে মিলে এগিয়ে যাওয়া যাক। পথটার নাম? পাভলভ। সে আবার কী? আসলে ওই বৈজ্ঞানিকেরই নাম, যাঁর কথা তোমায় বলছিলাম। তাঁরই নাম থেকে রাস্তাটার নামকরণ করা হয়েছে যে!
নির্জন পথ। কেবল দূর থেকে কুকুরের অষ্পষ্ট ডাক আমাদের কানে আসবে। তাই শুনে তুমি হয়তো আমার কাছ ঘেঁষে এসে শুধোবে, এ- তল্লাটে কি কুকুরের উৎপাত আছে নাকি মশায়? না, না, তা নয়।
উৎপাত কিছু নয়। তবে কুকুর নিয়ে অনেক ব্যাপারই দেখতে পাওয়া যাবে। কেবল একটুখানি সবুর করতে হবে, এই যা।
তারপর হাঁটতে হাঁটতে আমরা গিয়ে পৌঁছুবো সেই ল্যাবরেটরির সামনে। কিন্তু ওকি? বাগানের মধ্যে একটা ছোট্ট স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে না? আমরা নিশ্চয়ই ওটার ওপর ঝুঁকে পড়বো। আর একেবারে অবাক হয়ে যাবো।
কেননা ওটা কোনো মানুষের উদ্দেশ্যেই নয়। তার বদলে বুঝি এক কুকুরের স্মৃতিস্তম্ভ! কুকুরটা না কি বড়ো বিখ্যাত ছিল : কতো আশ্চর্য পরীক্ষা করা হয়েছে তার ওপরে! যেদিন এই স্মৃতিস্তম্ভের ওপর থেকে পর্দা সরানো হলো সেদিন ঘটা-পটা খুব কম হয়নি। ৮ আগস্ট ১৯৩৫ : সেদিন ওখানে ছিল শরীরতত্ত্বের ব্যাপারে পৃথিবীর সবচেয়ে নামজাদাদের সভা!
কিন্তু ওই রকম অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবে না। এই তো সবে সকাল হয়েছে, ল্যাবরেটরির কর্মীরা সব কাজে আসতে শুরু করেছেন। তাঁদের আপাদমস্তক ধপধপে সাদা জামা। চলো ওঁদের পেছু পেছু এগিয়ে দেখা যাক কাজ-কর্মের রকম-সকল কোন ধরণের।
পাথরের তৈরি একটা বিরাট ঘরের মধ্যে ওঁরা গিয়ে ঢুকছেন। সে-ঘরটায় ঢুকলে আমাদের মনে হবে, কুকুরের হাট বসেছে বুঝি! সাদা-জামা পরা কর্মীরা এতো কুকুরের ভেতর থেকে একটা করে কুকুর বেছে নিচ্ছেন : আজকে ওই কুকুরটা নিয়েই পরীক্ষা হবে। তাই দেখে তুমি হয়তো ভাববে, বিজ্ঞানের খাতিরে কুকুর বেচারার বুঝি আজ প্রাণ যাবে। তা কিন্তু মোটেই ঠিক কথা নয়। চলো না এবার ঢুকে পড়া যাক ল্যাবরেটারিটার ভেতরে আর দেখাই যাক না তার মধ্যে কুকুর হত্যার কোনো রকম আয়োজন আছে কি না।
ভেতরে ঢুকে আমরা দেখবো, একটি ফোঁটা রক্তের চিহ্ন তো নেইই, এমন কি কুকুরগুলোও যে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেলো তা ঠাহর করাও সম্ভব হবে না। তার বদলে বাড়ির ভেতরের যে ব্যাপারে আমরা একেবারে হকচকিয়ে যাবো তা হলো নিঝুম স্তব্ধতা। পায়ের তলায় এতো পুরু গালছে যে পায়ের শব্দ এতোটুকুও হয় না, দুজন মানুষ যখন কথা বলছে তাও এমনই চাপা গলায় আর ফিসফিস করে যে দুহাত দূরে দাঁড়িয়েও আমরা কিছুই শুনতে পাবো না। আর তাছাড়া দেখবো, ঘরগুলোর মুখে এমন কায়দায় দু’পুরু দোর আঁটা যে বাইরের ছিটেফোঁটা শব্দও ভেতরে ঢোকবার যো নেই।
বাড়িটার নামই হলো, স্থব্ধতার প্রাসাদ বা টাওয়ার অফ সাইলেন্স। অন্য কোনো নাম হলে কোনোমতেই মানাতো না। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কী চলেছে এই স্তব্ধতার রাজ্যের ভেতরে? কর্মীরা করছেন কি? আমরা দেখবো, সামনে খাতা খুলে তাঁরা বসে রয়েছেন। তাঁদের ঘিরে রয়েছে এতো অজস্র যন্ত্রপাতি, সুইচ আর ইলেকট্রিকের তার যে ডুবো জাহাজের ইন্জিন-ঘরও বুঝি এর কাছে হার মেনে যায়।
তাঁরা মাঝে মাঝে একটা পেরিস্কোপের ভেতরে উঁকি মেরে কী যেন দেখছেন আর তাছাড়া আশপাশের অতেশতে জটিল যন্ত্রপাতির মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে হরেক রকম সংকেত। আর মাঝে মাঝে সামনের খাতাটার ওপর ঝুঁকে পড়ে তাঁরা কী সব কথা টুকে নিচ্ছেন! তাঁদের ধৈর্য দেখে আমরা অবাক হয়ে যাবো কুকুরগুলোর কোনো চিহ্ন দেখতে না পেয়ে।
সত্যিই তো, কুকুরগুলো গেলো কোথায়? উত্তর পাওয়া যাবে ঘণ্টা খানেক কিংবা ঘণ্টা দেড়েক পরে। আমরা দেখবো সামনের খাতাটা বন্ধ করে ল্যাবরেটরির কর্মী উঠে দাঁড়ালেন, আর আশপাশের রকমারি সব সুইচ বন্ধ করতে করতে হয়তো আপন মনেই বললেন : আহা, আজকের পরীক্ষাটা বড়ো জমেছিল, কুকুরটা রিফ্লেকস দিয়েছে খাসা।
তুমি নিশ্চয়ই তাই শুনে জিজ্ঞেস করবে : রিফ্লেকস আবার কি মশায়? তাছাড়া কুকুরটাই বা কোথায় যে রিফ্লেকস দিলো? তোমার প্রথম প্রশ্নটার জবাবের জন্য একটুখানি সবুর করো। কিন্তু দ্বিতীয়টার জবাব পাবে চাক্ষুষ। দেখবে, একটা ঘরের দু’পুরু দরজা ঠেলে সরানো হলো, তার ভেতরে একটা চৌকির ওপর থেকে নেমে পড়ে এই জন্যে একটা কাঠামোর সঙ্গে তার লেজা-মড়ো বাঁধা রয়েছে, তাছাড়া তার গালের পাশে ফুটো করে একটা নল এমন কায়দায় চালিয়ে দেওয়া হয়েছে যে মুখের ভেতরকার সবটুকু লালা ওই নলের মধ্যে গিয়ে পড়ে। নলের অপর প্রান্তে একটা যন্ত্র, তাইতে হিসেব উঠছে ঠিক কফোঁটা লালা কাটলো।
ওর মুখের সামনে খাবারের প্লেটটা পৌঁছে দিলো কে? সে এক ইলেকট্রিকের যন্ত্র। কেননা পরীক্ষা যতোক্ষণ চলেছে ততোক্ষণ পর্যন্ত ঘরের মধ্যে কারুরই যাবার যো নেই, এতোটুকু ফালতু শব্দও নয়, এমনকি ঘরের আলোতেও এতোটুকু হেরফের হলে চলবে না- যিনি পরীক্ষা করেছেন তিনি ঠিক যেটুকু ইতর-বিশেষ চান ঘরের ভেতর কাঁটায় কাঁটায় শুধু সেইটুকু ইতর-বিশেষ!
সংকলন: দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ”শোন বলি মনের কথা” স্তব্ধতার প্রাসাদ।