টলেমি’র মানচিত্রে রামু’র গুরুত্ব

শিরুপন বড়ুয়া

রামু’র ইতিহাস সম্পর্কিত প্রতিটি লেখাতেই গ্রীক ভূগোলবিদ ক্লডিয়াস টলেমি এবং তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘জিওগ্রাফিয়া’র (Geographia)  প্রসঙ্গ চলে আসে। বলা যায় টলেমি’র প্রসঙ্গ ছাড়া রামু’র ইতিহাস অসম্পূর্ণ। রামু সম্পর্কে যাঁরা ইতিপূর্বে লিখেছেন, তাঁরা সবাই এই এলাকার প্রাচীনত্ব এবং অস্তিত্ব প্রমাণ করতে ১৫০ খ্রীষ্টাব্দে রচিত টলেমী’র “জিওগ্রাফিয়া” গ্রন্থের মানচিত্রের কথা বলেছেন। তাঁদের লেখাতে টলেমি’র মানচিত্রে রামু’র উল্লেখ আছে, শুধু এটুকু তথ্যই পাওয়া যায়।

রামু যদি টলেমি’র মানচিত্রে স্থান পেয়ে থাকে, তবে ধরে নিতে হবে সেসময় রামু বর্তমানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি জনপদ ছিল। হয়তো এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যার কারণে এর নাম এশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপ অবধি পৌঁছে যায়। সে হিসেবে রামু’র আয়তনও নিশ্চয় আজকের মতো ছিল না। বরং বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল রামু।

কেননা বর্তমানে রামু উপজেলার মতো ছোট একটি অঞ্চলকে টলেমি কেনইবা তাঁর মানচিত্রে চিহ্নিত করতে যাবেন?

তাই প্রশ্নটা সামনে চলেই আসে, টলেমি’র মানচিত্রে আদৌ কি রামু’র নাম আছে?

সহজ উত্তর, না।

তাঁর মানচিত্রে রামু নামে কোন অঞ্চলের নাম নেই। যদি থাকতো তবে রামু’র প্রাচীনত্ব এবং এর নাম নিয়ে আলোচনাটা আরো সহজ হয়ে যেত। তাহলে কিসের ভিত্তিতে টলেমি’র মানচিত্রে রামু’র নাম আছে, এমনটা বিশ্বাস করা হয়?

এ সম্পর্কে কিছু বর্ণনা পাওয়া যায় তৎকালীন রামু উপজেলার  থানা নির্বাহী অফিসার  আবুল কাসেম রচিত ‘রামু’র ইতিহাস’ গ্রন্থে। লেখকের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ, একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রামু’র ইতিহাস লেখা সোজা কথা না।

রামু’র প্রতি আন্তরিকতা না থাকলে এটা সম্ভব হতো না। তাঁর রচিত ‘রামু’র ইতিহাস ‘ বইটির প্রথম দিকে টলেমি’র মানচিত্র এবং রামু সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা যেত। কিন্তু তারপরও এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শ্রদ্ধেয় লেখক আবুল কাসেম যতটা যত্নের সাথে গবেষণা করে রামু’র ইতিহাস লিখেছেন তা ইতিপূর্বে আর কেউ করেননি।

টলেমি’র মানচিত্রে রামু’র অস্তিত্ব ছিল, এমন গঁৎবাধা ধারণাটি বিশ্বাস করার আগে কিছু বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার দরকার আছে।

বর্তমানের রামু উপজেলা তার ক্ষুদ্র আয়তন নিয়ে ১৫০ খ্রীষ্টাব্দে টলেমি’র মানচিত্রে স্থান করে নিবে এটা কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে অতীতে রামু’র আয়তন আজকের মতো ছিল না সেটা নিশ্চিত। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে মুঘলরা যখন চট্টগ্রাম জয় করে, তখন চট্টগ্রামের পাশাপাশি রামু ছিল আরাকানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ, এটা আলমগীরনামেতেই উল্লেখ আছে। তাছাড়া রালফ ফিচ আরাকান এবং রামুকে একটা একক দেশ হিসেবে Kingdom of Recon and Rame বলেছেন।

রামু’র উল্লেখ পাওয়া যায় ত্রিপুরা রাজ্যের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ রাজমালায়।

ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে অনেক ইউরোপীয় পর্যটক, বণিক, এবং ধর্মীয় যাজকগণ আজকের রামুকে ব্যবহার করতেন আরাকান থেকে বাংলায়, এবং বাংলা হতে আরাকানে প্রবেশের দরজা হিসেবে। এমনকি আরাকান শাসনামলে অনেক সময় রামু থেকে চট্টগ্রামের শাসনকার্য পরিচালনা করা হতো, এ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য ইতিহাস বই থেকে পাওয়া যায়।

১৮২৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে ফ্রান্সিস বুকানন কোম্পানির আদেশে চট্টগ্রাম এবং এর দক্ষিণাঞ্চলে জরিপ চালানোর পর একটি প্রবন্ধ লেখেন যার নাম ‘An Account of the Frontier between the Southern part of Bengal and the  Kingdom of Ava’ । সেই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন যে, চকোরিয়া, দুলাহাজরা, ঈদগাহ, এগুলো কোন গ্রাম নয়, বরং উপত্যকা। এসব এলাকায় ঘনবসতি নেই বললেই চলে। তিনি আরও লিখেন, ইসলামাবাদ অর্থাৎ চট্টগ্রাম এবং রামু’র মধ্যবর্তী আর কোন বড় শহর বা গ্রাম নেই। আরও অনেক ঐতিহাসিক উপাদান থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, অতীতে সবদিক থেকেই রামু বড়সড় একটা গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল। তাই টলেমি’র মানচিত্রে রামু’র স্থান পাওয়া অসম্ভবও নয়। তারপরও এ বিষয়ে বেশ বিতর্ক আছে। তাই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে টলেমি’র ‘জিওগ্রাফিয়া’ থেকেই শুরু করতে হবে।

‘জিওগ্রাফিয়া’ বইটি ৮টি খন্ডে বিভক্ত। বইটিতে টলেমি ইন্ডিয়াকে গঙ্গা নদী দ্বারা দুভাগ করেছেন। গঙ্গার ভেতরের অংশ বা Within Gangem, এবং গঙ্গার বাইরের অংশ বা Extra Gangem। বইটির ৭ম খন্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ে গঙ্গা নদীর বাইরে থাকা ভারতীয় অঞ্চলের বর্ণনা করা হয়েছে।

বইটিতে এশিয়ার মোট ১২ টি মানচিত্রের মধ্যে ১১তম মানচিত্রটিতে টলেমি গঙ্গার বাইরে থাকা বিভিন্ন অঞ্চলের অবস্থান দেখিয়েছেন, যা মূলত বর্তমানের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া। এই ১১তম মানচিত্রটিতে স্থান পেয়েছে আজকের বঙ্গোপসাগর এবং এর পূর্ব পাশের এলাকাগুলো।

গঙ্গার বাইরে ভারতীয় সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি প্রথমেই যে উল্লেখযোগ্য শহরের কথা বলেছেন, তা হচ্ছে পেন্টাপলিস বা পঞ্চ পল্লি বা শহর (Pentapolis), এরপর কাটাবেদা নদী (Katabeda river)। এই কাটাবেদা নদী হতে আরো দক্ষিণে টকোসানা নদী (Tokosanna river)। দুই নদীর মাঝখানে যে জায়গা, সেটাকে টলেমি বলেছেন বড়কুরা বা বড়কৌরা এম্পোরিয়াম (Baracura Emporium বা Barakoura Emporium)। তাঁর মতে সমুদ্র তীরে অবস্থিত বড়কুরা হচ্ছে একটি বাজার বা বানিজ্যিক এলাকা।  এর আরো দক্ষিণে হচ্ছে আর্জেন্টিয়া রেজিও (Argentea Regio),  যাকে গ্রীকরা  রৌপ্য রাজ্য বা Kingdom of Silver বলেই জানতো। তিনি ‘বড়কুরা এম্পোরিয়াম’কে বলেছেন আর্জেন্টিয়া রেজিওতে প্রবেশের দরজা।

টলেমি’র মানচিত্রের এই ‘বড়কুরা এম্পোরিয়াম’ (Baracura) হতে পারে আজকের রামু। কিন্তু আরও দুটি অঞ্চল এই ‘বড়কুরা’র স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার। একটি হচ্ছে বর্তমান বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ, এবং অন্যটি City of Bengala বা শুধু ‘বাঙ্গালা’। টলেমি’র মানচিত্রের ‘বড়কুরা’ বা ‘বড়কৌরা’ স্থানটিকে অনেকেই রামু বলতে চান না। তাদের দাবি এই ‘বড়কুরা’ আসলে বাংলা।

অনেকেই আবার এটিকে বর্তমানের বাকেরগঞ্জ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারমানে ‘বড়কুরা’ (Baracura) যদি বাঙ্গালা অথবা বাকেরগঞ্জ জেলা হয়, তাহলে টলেমি’র মানচিত্রে রামু’র উল্লেখ আছে এ ধারণা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। এই জটিল সমস্যার সমাধান বের করতে হলে জিওগ্রাফিয়া গ্রন্থে থাকা এশিয়া অঞ্চলের ১১তম মানচিত্রটি বিশ্লেষণ করতে হবে।

ভূগোলবিদ উইলফোর্ডের (Wilford) মতে টলেমি’র  মানচিত্রের কাটাবেদা নদীই হচ্ছে আজকের কর্ণফূলী নদী এবং পেন্টাপলিস হলো আজকের চট্টগ্রাম, যা ছিল মূলত পাঁচটি গ্রামের সমষ্টি। আবার অনেকের মতে চারটি গ্রামের সমষ্টি হচ্ছে চতুর্গ্রামা (Chaturgrama), এবং চতুর্গ্রামা থেকে চট্রগ্রাম। তারও উত্তরে প্রাচীন জনপদ কিরাটা। এই পাঁচটি অঞ্চল নিয়ে টলেমি’র পেন্টাপলিস বা পঞ্চ নগরি।

উইলফোর্ড এবং লেসেন  (Lassen) উভয়ই টকোসানা নদীকে সনাক্ত করেন আরাকান নদী হিসেবে। অন্যদিকে ইয়ুল ( Yule) এটিকে বলেছেন নাফ নদী। মূলত এই নদীর তীরে বসবাসকারী ‘টেকে নাফ’  (Teke Naf)   নামক উপজাতির নাম থেকেই ইয়ুল নদীর নামটি বেছে নিয়েছেন। তারমানে বর্তমানে বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ এর নামও সম্ভবত এই উপজাতির নামের সাথে সম্পর্কিত। তবে বর্তমানে এ নামে কোন উপজাতি ঐ অঞ্চলে নেই। ইয়ুলের (Yule) মানচিত্রে বড়কুরা বা বড়কৌরা এম্পোরিয়াম স্থান পেয়েছে রামাই (Ramai) নামে, যা আজকের রামু।

Mon. D’Anville লেখা গ্রন্থে টলেমি’র মানচিত্রে স্থান পাওয়া আর্জেন্টিয়া রেজিও হচ্ছে আজকের আরাকান। তাঁর ”A Geographical Illustration Of The Map of India’ গ্রন্থটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৭৫৯ সালে লন্ডন থেকে। ঐ বইটিতে টলেমি’র মানচিত্রে স্থান পাওয়া বড়কুরা এম্পোরিয়ামকে (Baracura Emporium) স্থলপথে আজকের আরাকানে প্রবেশের দরজা বলা হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই রামু ব্যবহৃত হয় আরাকান হতে বাংলায় এবং বাংলা হতে আরাকান প্রবেশের একমাত্র স্থলপথ হিসেবে। আরাকান শাসনামলে তো বটেই, এমনকি মুঘলদের রামু বিজয়ের ইতিহাস হতে এই তথ্য পাওয়া যায়।

ইংরেজ শাসনামলেও অন্তত ১৮২৪ সালের আগ পর্যন্ত রামু ছিল ভারতবর্ষের সর্ব দক্ষিণের ব্রিটিশ ঘাঁটি।

শ্রী নগেন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক সংকলিত এবং প্রকাশিত ১৩১৩ বাংলা সালে প্রকাশিত ‘বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে রামুকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘বংশকরা’ হিসেবে। বলা হয়েছে  এটি চট্টগ্রামের দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত একটি প্রাচীন নগর যা রামু বা রামাই নামে পরিচিত। এই রামাই আবার ইয়ুলের মানচিত্রের রামাই এর সাথেও মিলে যায়। আরো বলা হয়েছে টলেমীর জিওগ্রাফিয়া গ্রন্থে Baracura (বা Barakoura) এর সাথে Emporium শব্দটি যোগ করে এখানে যে বিশাল বানিজ্যিক কর্মকান্ড ছিল, তা বুঝানো হয়েছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, টলেমী’র Baracura বা বড়কুরার সাথে বংশকরা শব্দের কিছুটা মিল আছে।

১৮০৩ খ্রীষ্টাব্দে লন্ডন থেকে প্রকাশিত A New Dictionary of Ancient Geography গ্রন্থে লেখক Charles Pye ‘বড়কুরা’ শহরটি প্রাচীনকালে একটি বানিজ্যিক এলাকা ছিল বলে মন্তব্য করেন। A manual of Ancient Geography গ্রন্থেও এরকম পাওয়া যায়।

বঙ্গোপসাগরের পূর্বতীরের পেন্টাপলিস, কাটাবেদাকে কর্ণফুলি এবং টাকুসানা নদীর মর্ধ্যবর্তী স্থানে বড়কুরাকে (Baracura) একটি সমুদ্র বন্দর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এছাড়াও টলেমি’র ‘জিওগ্রাফিয়া’কে নিয়ে লেখা গবেষণাধর্মী একটি বই হচ্ছে Ancient India as Described  by Ptolemy। বইটির লেখক  McCrindle এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে বলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রাচীন বানিজ্যিক কেন্দ্র বড়কুরা এম্পোরিয়ামের অবস্থান কাটাবেদা এবং টকোসানা নদীর মধ্যবর্তী স্থানে।

‘বড়কুরা’ বা ‘বড়কৌরা’ শব্দ দুটিকে বিশ্লেষণ করলেও অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

‘বড়কুরা’ বা ‘Baracura’  শব্দের ‘ur’ এবং ‘বড়কৌরা’ বা ‘Barakoura’ শব্দের ‘koura’, এই দুটি শব্দকেই দ্রাবিড়িয়ান শব্দ ‘ur’ এর সমতুল্য মনে করা হয়, যার অর্থ হলো ‘শহর’। টলেমি’র মানচিত্রে ভারতীয় বেশ কিছু এলাকার নামের শেষ অংশে ”ura’ বা ”koura’ শব্দটি দেখা যায়। প্রফেসর লেভি (Levy) মনে করেন দক্ষিণ এশিয়ার অনেক শহর এবং অঞ্চলের নাম ‘পুরা’, ‘পারা’, ‘উরা’, ‘আরা’, ‘কুরা’, ‘কৌরা’, ‘কোট’ ইত্যাদি।

বিশেষ কিছু প্রত্যয় যোগে সম্পূর্ণ হয়েছে যা মূলত অস্ট্রিক-মুন্ডা জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত।

তাহলে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ‘বড়কুরা’ হচ্ছে বড় শহর। ‘বড়কুরা’ (Baracura) যদি আজকের রামু হয়ে থাকে, তবে এটা বলা যায় যে, প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানদের কাছে রামু ছিল একটি বানিজ্যিক শহর, যা আরাকান রাজ্যের প্রবেশদ্বার।

E.H. Warmington মনে করেন টলেমি’র বড়কুরা এম্পোরিয়াম চট্টগ্রামের ৬৮ মাইল দক্ষিণ -পূর্বে রামু’র কাছাকাছি কোথাও ছিল, এবং এই বানিজ্যিক শহরের সাথে রোমান সাম্রাজ্যের বণিকদের স্থলপথে যোগাযোগ ছিল।

ইতিহাসবিদ মতি চন্দ্রও মনে করেন প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের বণিকরা সম্ভবত রামু’র সাথে পরিচিত ছিল। কারণ মূলত বনিকদের কাছ থেকেই Barakoura নামটি টলেমী  শুনেছিলেন।

মধ্যযুগের বিভিন্ন মানচিত্র হতে রামু যে একটি সমুদ্র বন্দর ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

ডাচ কার্টোগ্রাফার William Janszoon Blaeu (১৫৭১-১৬৩৮) ১৬৩৪ সালে ভারতবর্ষের একটি মানচিত্র অংকন করেন। ঐ মানচিত্রে রামুকে একটি সমুদ্র বন্দর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ৬ বছর পর ১৬৪০ সালে সুইজারল্যান্ডের মানচিত্রকর Mathaus Merian (1593-1650) ‘India Orientalis et Insulae Adiecentes’ শিরোনামে ভারতবর্ষের আরও একটি মানচিত্র অংকন করেন। ঐ মানচিত্রেও রামুকে একটি সমুদ্র বন্দর হিসেবে দেখানো হয়েছে।

১৬৬৬ সালে মুঘলরা আরাকান রাজাকে পরাজিত করে রামু জয় করে। তখনো রামু একটি সমুদ্র বন্দর ছিল।

নাবিক এবং বণিকদের জন্য ১৬৬৯ সালে ডাচ মানচিত্রকর Hendrick Donker এর আঁকা একটি সী চার্ট মানচিত্র সেটাই প্রমাণ করে। এ ধরণের সী চার্টগুলোতে সাধারণত উপকূলীয় এলাকা এবং দ্বীপ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা থাকে। সমুদ্রের দূরবর্তী মূল ভূখন্ড সম্পর্কে তেমন কোন বর্ণনা সী চার্ট মানচিত্রে থাকেনা। Donker এর সেই মানচিত্রে রামুকে একটি সমুদ্র বন্দর হিসাবে দেখানো হয়েছে। একই রকম আরও একটি সী চার্ট মানচিত্রে রামু সমুদ্র বন্দর হিসেবে স্থান পেয়েছে। ঐ মানচিত্রটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য অংকন করেন ইংরেজ মানচিত্রকর John Thornton, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৬৮০ সালে। মানচিত্রটি পরবর্তীতে ১৭০৩ সালে John Thornton এর ‘Pilot, The Third Book’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

অন্য এক ডাচ মানচিত্রকর Jan Jansson এর আঁকা মানচিত্রে রামুকে দেখানো হয়েছে P. de Romeo হিসেবে। অর্থাৎ Port of Ramu বা রামু’র বন্দর। মানচিত্রটি Jan Jansson এর লেখা ‘Atlantis Maioris’ ৫ম খন্ড থেকে নেয় যা ১৬৫০ সালে প্রকাশিত হয়। এই মানচিত্রটির উপরের দিক হচ্ছে পশ্চিম। অর্থাৎ এটি একটি West Oriented map. এই মানচিত্রে সেন্টমার্টিন আই ল্যান্ডকে  চিহ্নিত করা হয়।

ইউরোপীয়দের লেখায় বাঁকখালী নদীর মোহনা পরিচিত ছিল Curoozcool Bay (খুরুস্কুল বে)  নামে।  এখানে বানিজ্যিক কার্যক্রম চলতো, এবং এই মোহনা দিয়ে ইউরোপীয়রা বাঁকখালি নদী হয়ে রামু’র অভ্যন্তরে প্রবেশ করতো। ইউরোপীয়দের লেখা হতেই জানা যায় যে, বাঁকখালী নদীর পূর্ব নাম ছিল খুরুসিয়া। আর আজকের খুরুস্কুলের নাম ঐ খুরুসিয়া থেকে এসেছে। প্রাচীন আমল হতে মধ্যযুগ, এমনকি ব্রিটিশ আমলেও বিভিন্ন দেশের পর্যটক বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এই অঞ্চলের বিভিন্ন নদী দিয়ে রামুতে প্রবেশের কথা আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি।

বর্তমান উখিয়ার রেজুখাল এবং টেকনাফের নাফ নদী হয়েও রামুতে প্রবেশ করতো দেশী বিদেশী জাহাজ। রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নে এখনো জাহাজ ঘাটা নামে একটি জায়গা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা এটাকে সৈন্য ও অস্ত্র পরিবহণের কাজে ব্যবহার করতো।

বর্তমানে বাংলাদেশের সমস্ত সমুদ্র উপকূলের আলাদা কোন নাম না থাকলেও মধ্যযুগের কিছু মানচিত্রে রামু’র সমুদ্র সীমানাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা বঙ্গোপসাগরের অন্তর্ভুক্ত।

উইলিয়াম বাফিন এবং স্যার টমাস রোয়ে যৌথভাবে ভারতের একটি মানচিত্র অংকন করেন, যা ১৬১৯ সালে প্রকাশিত হয়। এই মানচিত্রে বর্তমানের কক্সবাজার জেলার সমস্ত এলাকা Golfe de Rama নামে স্থান পেয়েছে। ঐ মানচিত্রটির একমাত্র অরিজিনাল কপিটি ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। এই লেখার সাথে দেওয়া মানচিত্রটি একটি ফরাসী ভার্সন। তাই এখানে রামুকে ‘রামা’ লেখা হয়েছে। ফরাসিরা হয়তো রামুকে ‘রামা’ বলতো।

তারও আগে ১৫৯৮ সালে Petrus Betrius  বাংলার মানচিত্র অংকন করেন। তাঁর মানচিত্রেও রামু’র উপকূল চিহ্নিত করা হয়েছে গালফ ডি রামে নামে (G. de Rame)। মানচিত্রটি প্রকাশের এক দশক আগে চট্টগ্রাম এবং রামুতে আসা ইংরেজ বণিক এবং পর্যটক রালফ ফিচ তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে Kingdom of Recon And Rame  এর কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে Recon হচ্ছে আরাকান, এবং Rame হলো রামু। আরাকান এবং রামুকে একসাথে  একটি রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করার কারণে রামুর গুরুত্ব চট্টগ্রামের চেয়েও বেড়ে যাচ্ছে,  এমনটাই মনে করেন ইতিহাসবিদ সুনিতি ভূষণ কানুনগো। আর এ কারণেই হয়তো ইউরোপিয়রা  রামু’র সমুদ্র সীমাকে রামু’র উপসাগর হিসেবে মানচিত্রে চিহ্নিত করেছে।

এতক্ষণ ধরে যে আলোচনা হলো তা থেকে একটা বিষয় পরিস্কার যে, অতীতে টলেমি’র মানচিত্রে স্থান পাওয়ার মতো গুরুত্ব রামু’র যথেষ্ট পরিমানে ছিল। কিন্তু বাকেরগঞ্জ এবং City of Bengala বা বাঙ্গালা’র বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে না এসে টলেমি’র মানচিত্রের ‘বড়কুরা এম্পোরিয়াম’ই রামু, এটা দাবী করা উচিত হবে না।

ইতিহাসের এই বিতর্কটির জন্ম দিয়েছে মূলত পর্তুগিজরা। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকের ইউরোপীয় লেখকদের মধ্যে বিশেষ করে পর্তুগীজদের লেখায় মেঘনা নদীর মোহনায় City of Bengala নামে একটি নগরের কথা জানা যায়। বাকেরগঞ্জ জেলা এবং চট্টগ্রামের মধ্যকার বিশাল এলাকা নিয়েই গঠিত মেঘনা নদীর মোহনা। ইতিহাসবিদ আর. সি. মজুমদার মনে করেন, বর্তমানের চট্টগ্রামের কাছেই ছিল সেই city of Bengala, বা বাঙ্গালার শহর।

১৫৬১ খ্রীষ্টাব্দ হতে ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপীয় মানচিত্রকররা এই অঞ্চলের মানচিত্র আঁকতে গিয়ে চট্টগ্রামের পাশেই বাঙালা বা বেঙ্গালা (Bengala) নামে একটি জায়গা চিহ্নিত করেন।

Yule এর মতে মধ্যযুগে বাংলার রাজধানী ছিল সোনারগাঁও, এবং তা  সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু ইয়ুল মনে করেন কোন কোন ভূগোলবিদ তাঁদের মানচিত্রে চট্টগ্রামের খুব কাছেই ‘বাঙ্গালা’ নামে একটি জায়গাকে সোনারগাঁও বলে ভুল করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছে  স্যার টি হার্বাট। তিনি বাংলার প্রাচীন নাম ‘বড়কুরা’ বলেছেন যা টলেমি’র মানচিত্রে স্থান পেয়েছে।

কিন্তু ইয়ুল তা নাকচ করে দেন। আমার মতে ইয়ুলকে সমর্থন করার যথেষ্ট কারণ আমাদের আছে। প্রাচীন গঙ্গারিডি রাজ্যই আজকের বাংলা, এমনটাই মনে করেন বহু ইতিহাসবিদ। সেই গঙ্গারিডি রাজ্য টলেমি’র ১০ম মানচিত্রে স্থান পেয়েছে গঙ্গা নদীর ভেতরের রাজ্য হিসেবে। কিন্তু আমরা কথা বলছি ‘বড়কুরা’ নিয়ে, যা তাঁর ১১তম মানচিত্রে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে স্থান পেয়েছে, এবং ঐ স্থানকেই আমরা মনে করছি আজকের রামু।

ইউরোপীয় মানচিত্রকরদের মধ্যে কেউ কেউ এই বাঙ্গালাকেই টলেমি’র বড়কুরা এম্পোরিয়াম বলেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জার্মান মানচিত্রকর Petrus Apianus (1495 – 1552)। তিনি টলেমি’র মানচিত্রের বড়কুরাকে City of Bengala বলে চিহ্নিত করেছেন, যার অবস্থান চট্টগ্রামে। অপরদিকে ইতালিয়ান মানচিত্রকর Giacomo Gastaldi (1500-1566) এর মতে বাকলা (Bakla) বা বাকালা (Bacala) হচ্ছে বড়কুরা, যা আজকের বাকেরগঞ্জ জেলা।

Abraham Ortelius এর ‘Thesaurus Geographicus’ প্রকাশিত হয় ১৫৮১ সালে। উক্ত গ্রন্থে বড়কুরা এম্পোরিয়াম সম্পর্কে তিনি নিজস্ব কোন মতামত দেননি। তিনি আপিয়ানাস এবং গ্যাস্টেলডি, দুজনের দুটি ভিন্ন মত তুলে ধরেছেন।

স্যার আর্থার পি ফেয়রি (Sir Arthur P Pharye) তাঁর হিস্টি অব বার্মা, (History of Burma)  গ্রন্থে বাকলা (Bakla) কে  বলেছেন আজকের বাকেরগঞ্জ (পৃ ১৭৪)। যদিও তিনি বাকেরগঞ্জ শহরকে টলেমি’র বড়কুরা এম্পোরিয়াম বলেন নি, কিন্তু ইতালিয়ান মানচিত্রকর গ্যাস্টেলডি’র যুক্তি মেনে নিলে টলেমি’র মানচিত্রে বড়কুরা এম্পোরিয়াম (Baracura Emporium) দ্বারা রামুকে নয়, বরং বাকেরগঞ্জকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু টলেমি’র মানচিত্রে ‘বড়কুরা’র ভৌগোলিক অবস্থান স্পষ্টতই আরাকানের সামান্য উত্তরে এবং চট্টগ্রামের দক্ষিণে। তাই ‘বড়কুরা’ বা ‘বড়কৌরা’ কোনভাবেই বাকেরগঞ্জ জেলা হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, বাকেরগঞ্জ বরিশাল বিভাগের অন্তর্ভুক্ত, যার সাথে আরাকানের দূরত্ব অনেক।

কিন্তু স্বয়ং টলেমি’র মতে ‘বড়কুরা’ (Baracura) হচ্ছে আরাকানে প্রবেশের দরজা। তাই ‘বড়কুরা’ বাকেরগঞ্জ নয়, এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায়।

বাকি থাকে পর্তুগীজদের মানচিত্রে এবং বিভিন্ন লেখায় City of Bengala বা বাঙ্গালার শহর নামে চট্টগ্রামের খুব নিকটেই অবস্থিত একটি রহস্যময় স্থানের সরব উপস্থিতি। এই City of Bengala যদি টলেমি’র ‘বড়কুরা’ এম্পোরিয়াম হয়, তবে এতদিন ধরে তাঁর মানচিত্রে রামু’র ভৌগোলিক অস্তিত্ব থাকার প্রচলিত ধারণাটা সত্যিই হুমকির মুখে পড়বে। সেই সাথে রামু’র প্রাচীনত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। তাই পর্তুগীজদের City of Bengala, টলেমি’র ‘বড়কুরা এম্পোরিয়াম’ এবং আমাদের ‘রামু’ এই তিনটি বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত ।

মধ্যযুগের কিছু মানচিত্রের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যেখানে চট্রগ্রামের কাছাকাছি জায়গায় Bengala বা ‘বাঙ্গালা’ নামে একটি শহরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা শুধু মানচিত্রে, এবং পর্তুগিজদের লেখাতেই সীমাবদ্ধ। কেননা, এই নগরের কোন অস্তিত্ব বর্তমানে পাওয়া যায় না। কিন্তু মধ্যযুগে পর্তুগীজদের মানচিত্র এবং তাদের মানচিত্রের অনুকরণে আঁকা অন্যদের ভৌগোলিক বিবরণ ও মানচিত্রে চট্টগ্রামের খুব কাছেই Bengala বা বাঙ্গালা শহরটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

ভিনসেন্ট লে ব্লান্ক ১৫৭০ সালের দিকে city of Bengala ভ্রমণ করছেন বলে তাঁর লেখায় দাবী করেছেন। তিনি বাংলায় আসার পর এই রাজ্যের একটি প্রধান নগরীতে আসেন, পর্তুগিজরা যে শহরকে ডাকে city of Bengala.

কিন্তু তাঁর বিবরণীকে যতটা না বাস্তব তারচেয়ে বেশি কাল্পনিক মনে করেন পরবর্তী ইতিহাসবিদগণ। তারপরও বাঙ্গালা নামের শহরটি সম্পর্কে ভিনসেন্টের বক্তব্যকে সঠিক ধরে নিলে বাঙ্গালার অবস্থান চট্টগ্রামের কাছাকাছি নয় বরং আরো দূরে হওয়ার কথা। কারণ তিনি city of Bengala এর অবস্থান সমুদ্র থেকে দুই দিনের পথ বলে উল্লেখ করেন। তাছাড়া লে ব্লান্ক তাঁর লেখায় আলাদাভাবে গৌড়ের কোন উল্লেখ করেননি, তাই এটা সহজেই অনুমেয় যে তিনি আসলে city of Bengala বলতে গৌড়কেই বুঝিয়েছেন। কারণ, ষোড়শ শতকে গৌড় সমুদ্র উপকূলের আরো কাছে ছিল। তাই সমুদ্র থেকে দুই দিনে খুব সহজেই গৌড়ে যাওয়া সম্ভব।

Duarte Barbosa (c. 1480 – 1 May 1521)

বারবুসা তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে চট্টগ্রামের কোন উল্লেখ করেননি। তবে বাংলার একটি সমুদ্র বন্দরের উল্লেখ করেন যার নাম city of Bengala, যা বাঙ্গলা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।

ইউরোপীয় লেখক Purchas এবং Mandelslo তাঁদের লেখায় বাঙ্গালা নামের একটি শহরের কথা উল্লেখ করেছেন, যা বর্তমান চট্টগ্রামের কাছেই অবস্থিত ছিল। কিন্তু এই দুজনের কেউ ব্যক্তিগতভাবে বাংলায় আসেননি। তাঁরা বিভিন্ন পর্যটক এবং বণিকদের দেয়া তথ্য মতে বাংলার বিবরণ লিখেন।

পর্তুগীজ পর্যটক বারবুসা’র লেখায় city of Bengala বা বাঙ্গালার শহরটিকে মুসলমান শাসিত নগর বলা হয়েছে (Biographie Universelle, p. 330)। এমনকি ভারথেমা’র (Verthema) লেখাতেও বারবুসাকে সমর্থন করে city of Bengala কে একটি মুসলমান শাসিত অঞ্চল বলা হয়েছে। ১৫০৩ সাল থেকে ১৫১০ সালের মধ্যে ভারতের ভ্রমণ করা ভার্থেমা City of Bengala কে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট বাণিজ্যিক নগরীর একটি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যার শাসক একজন মুসলমান। কিন্তু ইউরোপীয়রা যখন চট্টগ্রাম এবং রামুতে আসা শুরু করে তখন এই অঞ্চল আরাকান এবং ত্রিপুরা রাজা কর্তৃক শাসিত হতো।

মধ্যযুগে বিখ্যাত গৌড় এর বাইরে যদি অন্য কোন বাঙ্গলা নামে নগরীর অস্তিত্ব থাকতো, যা হিন্দু বা বৌদ্ধ রাজা দ্বারা শাসিত, তবে বিষয়টি অন্যরকম হতো। বাংলা ভ্রমণে আসা প্রথম দিকের ইউরোপীয়দের বর্ণনায় City of Bengala একটি মুসলমান শাসিত নগর। কিন্তু যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে ঐসময় গৌড় ছাড়া এই বিশাল বাঙ্গলায় দ্বিতীয় কোন ‘বাঙ্গালা’ নামের নগরী ছিল না যা গৌড়ের সমকক্ষ হতে পারে। এমনকি সমকালীন মুসলমান ঐতিহাসিকগণের লেখায় গৌড় ছাড়া মুসলমান শাসিত অন্য কোন এলাকাকে বাঙ্গলার শহর বা বর্তমান চট্রগ্রামের কাছাকাছি জায়গায়  পর্তুগীজদের বর্ণিত ‘বাঙ্গালা’ শহরটির কথা উল্লেখ নেই।

তাই মধ্যযুগে আঁকা এই এলাকার পর্তুগিজ মানচিত্রে চট্টগ্রামের খুব কাছেই বাঙ্গালা বা বেঙ্গালা (Bengala) নামের অঞ্চলটি দ্বারা কোন শহরকে বুঝানো হয়েছে তা আজও একটা রহস্য।

প্রায় সব পর্তুগীজ ভ্রমণকারীদের বিবরণীতে City of Bengala বা বাঙ্গালার শহরকে তিনশত বছর ধরে মুসলমান শাসক দ্বারা শাসিত বলা হয়েছে। তাই যদি হয় তবে এটা নিশ্চিতভাবেই গৌড়। কেননা বখতিয়ার খিলজি গৌড় জয় করেন ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দের দিকে, এবং তারও তিনশত বছর পর ইউরোপীয়রা বাঙ্গলায় আসে।

Beveridge তাঁর The District of the Bakarganj গ্রন্থের ভূমিকায় City of Bengala সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে ইতালির ভেনিস হতে ১৫৫০ সালে প্রকাশিত Ramusio এর ভ্রমণ বিষয়ক বিবরণী ‘Collection of Travels’ বইটি পড়লে একটা বিষয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায়। আর সেটা হচ্ছে, হারিয়ে যাওয়া City of Bengala বলতে আসলে মধ্যযুগের বাঙ্গালার বিখ্যাত নগর ‘গৌড়’ কে বোঝানো হয়েছে। যা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় অবস্থিত।

Francis Fernandes বাংলা রাজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, কিংডম অব রামু বা পর্টো গ্রান্ডে (চট্রগ্রাম) এর সীমানা হতে পর্টো পিকুইনো’র অর্থাৎ হুগলি বন্দরের আরো ৯০ মাইল উত্তরে পর্যন্ত বাংলা রাজ্য। যার দৈর্ঘ ৬০০ মাইল। তাঁর বর্ণনায় রামু আমরা একটি রাজ্য হিসেবে পাচ্ছি।

বারবুসার পর ভেনেসিয় পর্যটক Caesar Fredericke ১৫৬৩ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা ভ্রমণ করেন। তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে চট্টগ্রাম এবং এর কাছাকাছি জায়গায় বাঙ্গালা নামের কোন শহরের উল্লেখ নেই। এমনকি Hamilton তাঁর লেখায় চট্টগ্রামের কথা উল্লেখ করলেও ‘বাঙ্গালা’ নামে কোন উল্লেখ করেননি। শুধু তাই নয়, খোদ পর্তুগীজ ইতিহাসবিদ De Faria Y Souza (1590-1649) তাঁর ‘Portuguese Asia’ গ্রন্থে স্পষ্ট ভাষায় চট্টগ্রামের কথা উল্লেখ করলেও এর কাছাকাছি City of Bengala বা ‘বাঙ্গালার শহর’ নামে কোন জায়গার অস্তিত্ব থাকার কথা বলেননি। বরং গঙ্গার তীরবর্তী গৌড় নগরের কথা উল্লেখ করেন (Portuguese Asia, vol. I, pp. 96-97, 416-17)

ভার্থেমা এবং বারবুসা পরবর্তী সময়ের কোন পর্যটক এবং ইতিহাসবিদদের লেখায় চট্টগ্রামের খুব নিকটেই বাঙালা নামে কোন শহরের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ নেই, যদিও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছেন পার্কাস (Purchas) এবং ম্যান্ডেল্সলো (Mandelslo).  কিন্তু শেষের দুজন আদৌ স্বশরীরে বাংলা ভ্রমণ করেন নি। রেনেলের (Rennell) মতে, চট্টগ্রামের কাছে  ‘বেঙ্গালা’ বা ‘ বাঙ্গালা’ নামের শহরটি বই পত্রে এবং মানচিত্রে থাকলেও, বাস্তবে এই শহরের কোন অস্তিত্বই নেই।

Courtesao ১৯৪৫ সালের একটি প্রবন্ধে দাবী করেন, ষোড়শ শতকে পর্তুগিজরা যখন চট্টগ্রামে তাদের আস্তানা গড়ে তোলে, তখন তারা চট্টগ্রামকে পর্টোগ্রান্ডের পাশাপাশি Bengala বলতো। তার এই দাবিকে সমর্থন করা যায়। কেননা ইউরোপ হতে বাংলায় আসা সমসাময়িক বিখ্যাত পর্যটক যেমন রালফ ফিচ (১৫৮৬), উইলিয়াম হকিংস (১৬০৮-১৩), টমাস রোয়ে (১৬১৫), ফ্রান্কোয়েস বার্নিয়ার (১৬৫৬-৬৮) এমনকি স্যাবেস্টিয়ান ম্যানরিকের লেখায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে Bengala নামে কোন শহরের উল্লেখ নেই।

এ বিষয়ে অনিরুদ্ধ রায় তাঁর ‘The City of Bengala in the European Travel Accounts and Cartography’ প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন যে, City of Bengala নামে আলাদা কোন শহরের অস্তিত্ব অতীতে ছিলই না। বরং গৌড়ই ছিল city of Bengala (p.132).  প্রফেসর নিহার রঞ্জন রায়ও গৌড়কেই city of Bengala বলে সমর্থন দিয়েছেন।

আর গৌড়ই যদি পর্তুগিজদের বাঙ্গালা হয় এবং চট্টগ্রামকে তারা যদি বাঙ্গালার শহর বলে থাকতো তবে টলেমি’র ‘বড়কুরা’ কোনভাবেই সেই বাঙ্গালা হবে না। কারণ, গৌড়ের অবস্থান সমুদ্র উপকূলে নয়, বরং মূল ভূখন্ডের আরো ভেতরে। পক্ষান্তরে ‘বড়কুরা’র অবস্থান সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় রামু’র সাথে এর ভৌগোলিক অবস্থানগত মিল থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

অতীতে রামু নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল। কিন্তু এই এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা খুব কমই হয়েছে। তাছাড়া আজকে যে অঞ্চল প্রশাসনিকভাবে রামু নামে পরিচিত, অতীতে এর সীমা আরো বিস্তৃত ছিল। বর্তমান কক্সবাজার জেলার বেশিরভাগ এলাকা এমনকি এর আশপাশের এলাকা নিয়েই ছিল রামু। যেহেতু টলেমি’র মানচিত্রে সরাসরি রামু নামে কোন জায়গার নাম নেই, তাই তাঁর মানচিত্রে রামু’র অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নির্ভর করে ঐসময়ের কিছু অঞ্চলের প্রচলিত নামের উপর। শুধু ভৌগোলিক অবস্থান এবং বর্ণনার উপর নির্ভর করে বলা যায়, পেন্টাপলিস হচ্ছে আজকের চট্টগ্রাম, কাটাবেদা নদী বর্তমানের কর্ণফুলী এবং টকোসানা হচ্ছে নাফ নদী। এর মধ্যবর্তী বড় একটি অঞ্চলকে টলেমি বলেছেন বড়কুরা এম্পোরিয়াম, যা একটি বাণিজ্যিক এলাকা। টলেমি’র মতে ‘বড়কুরা এম্পোরিয়াম’ বা বড়কুরা বাণিজ্যিক শহরের পর টকোসানা নদী, এবং নদীর ওপারে আর্জেন্টিয়া যা বর্তমানে আরাকান। মুঘল আমলেও চট্টগ্রামের পর রামুই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সে হিসেবে ‘বড়কুরা এম্পোরিয়াম’কে রামু হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কারণ ব্রিটিশ আমলের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের পর এই দক্ষিণাঞ্চলে রামু’র সমকক্ষ আর কোন গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল না।  ইউরোপীয় বিভিন্ন পর্যটকদের ভ্রমণ বৃত্তান্তেও রামু একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হিসেবে স্থান পেয়েছে।

রামু’র এই ভাবমূর্তি নিশ্চয় একদিনে গড়ে উঠেনি। হয়তো টলেমি বা তারও পূর্ব থেকে এই জনপদের অস্তিত্ব ছিল। যার কারণ টলেমি তাঁর মানচিত্রে বড়কুরা’র স্থান দিয়েছেন, যা কালক্রমে রামু নাম ধারণ করেছে।

তথ্যসূত্র:

  •  J.W.  McCrindle, Ancient India as Described  by Ptolemy, London, 1885.
  • Charles pye, New Dictionary of Ancient Geography, London, 1803.
  • D.C Sircar, The Geography of Ancient and Medieval India, Delhi,1971.
  • Sir Arthur P Pharye, History of Burma, London, 1883.
  •  John Ranking, Historical Research on The Wars and Sports of the Mongols and Romans, Lindon, M.DCCCXXVI
  • Abraham Ortelius, Thesaurus geographics, 1674.
  • H.Bevaridge, The District of Bakarganj, London, 1876.
  • Colonel Henry Yule, Cathay and the Way Thither, VOL.2,  London, M.DCCCMLXVI
  • Peter Edmund Laurent, The Edinburgh Journal of Science, vol.।।। M.DCCC.XXV, London.
  • A Manual of Ancient Geography, Oxford,  1840.
  • Journal of the Malayan Branch of the Royal Asiatic Society Vol.8 1930.
  • Mon. D’Anville, A geographical illustration of a map of India,
  • Asiatick Researches, Calcutta 1822
  • Benoychandra Sen, Some Historical Aspects of the Inscriptions of Bengal, University of Calcutta,1942.
  • Sylvain levy, JEAN PRZYLUSKI, JULES BLOCH, Pre Aryan and Pre Dravidian in India,  translated by Prabodh Chandra Bagchi, New Delhi 1993.
  • Moti Chandra,Trade and trade routes in ancient India, New delhi, 1977.
  • শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসু, (সঙ্কলিত), বিশ্বকোষ, সপ্তদশ ভাগ, ১৩১৩ বাংলা সালে প্রকাশিত।
  • George Percy Badger, The Travels of Ludovicco Di Varthema.
  • Arron Arrowsmith, A Grammar of Ancient Geography. London, 1832.
  • H. Blochmann, Geography, and History of Bengal, Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol.XLII.

ছবি: ইন্টারনেট এবং

https://mappingbengal.com

https://www.raremaps.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *