শিপ্ত বড়ুয়া
এই পৃথিবীতে নতুন প্রাণের জন্ম! নারী কিংবা পুরুষ কেউই বোধয় খুব বেশি ভেবে নবজাতকের জন্ম দেন না। আজকে যে গল্পটি আপনাকে শুনাতে যাচ্ছি সেটি এক নারীর গল্প। আত্নকথা। যে শিশু এখনো জন্ম নেয়নি তার সাথে কথা।
একজন নারী, যার শরীরে প্রথম প্রাণের স্পন্দন ঘটে, সেই নারী নতুন শিশুর আগমনী বার্তা শুনেছেন। সজাগ ব্যক্তি হিসেবে তিনি নিজের দায়িত্ব নিয়ে দ্বিধান্বিত। ক্ষুধা, দারিদ্র, অপমান বঞ্চনা, কপটতাপূর্ণ এ পৃথিবীতে একজন নতুন মানুষ নিয়ে আসা কি ঠিক?
মানুষের জন্মের প্রক্রিয়াও এক সংগ্রামের মতো। তাকে অনেক প্রতিকূলতা পেরুতে হয়। এই দ্বিধার ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে এই পৃথিবী। এই ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে পুরনো মানুষের সৃষ্ট নিয়মবিধি সম্বলিত ব্যবস্থাবলিতে। এ সমস্যা শুধুমাত্র একজন নারীর নয়, সার্বজনীন।
পাঠক একক্ষণে বোধয় বইটি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়েছেন। উপরের দুই প্যারার লেখাটি বইয়ের কভারে ছাপা। বইয়ের নাম “হাত বাড়িয়ে দাও” অনুবাদ করেছেন শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী আনু মুহাম্মদ স্যার। আসল লেখা ইতালির খ্যাতিমান লেখক সাংবাদিক ওরিয়ানা ফাল্লাচি।
ওরিয়ানা ফাল্লাচি খুব সম্ভবত নিজের না বলা কথা এই বইটিতে বলতে চেয়েছেন। বলতে চেয়েছেন অপার এক কষ্টের কথা। বইটি বেশ কয়েকবার পড়েছি। বারবার মনে হয়েছে পৃথিবীকে শুধু একটি বিষয়ে ফাল্লাচি সচেতন করতে চেয়েছেন কিংবা বিপ্লবী করে তুলতে চেয়েছেন তার অনাগত শিশুর সাথে কাল্পনিক আলাপচারিতায়।
এই সমাজ নারী-পুরুষ বৈষম্য, দারিদ্র, শোষণ, শাসনের বৃত্তে বন্দি। তিনি স্পষ্ট করেই বলতে চেয়েছেন যে সমাজে আমি নিজেই সুস্থ নয়, ঠিকমতো দুবেলা খেতে পাইনা সেখানে পৃথিবীতে নতুন মানুষ আনার ব্যাপারে আমাদের ভাবা উচিৎ কিনা।
মূলত ওরিয়ানা ফাল্লাচির “লেটার টু আ চাইল্ড নেভার বর্ণ” গ্রন্থের ভাষান্তর হলো আনু মুহাম্মদ স্যারের “হাত বাড়িয়ে দাও”। এক অনাগত শিশুর উদ্দেশ্যে কুমারী মায়ের চিঠি। পড়া শুরু করলে মাত্র ৪৭ পৃষ্ঠার বইটি শেষ না করে উঠতে পারবেন না।
বইটির ৪৬ পৃষ্ঠায় “ব্যক্তি শব্দটি চমৎকার কেননা এই শব্দে কোনো নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই।” এবং “জীবন হচ্ছে পাথর-ফেলা রাস্তার মতো- যেখান দিয়ে চলতে তোমার অনেক কষ্ট হবে, হোঁচট খেতে হবে বারবার।” লাইনদুটো ভালো লাগার মতো।
ওরিয়ানা ফাল্লাচি এক পুরুষের সাথে প্রেমে জড়িয়েছিলেন, ভালোবেসেছিলেন। তাদের অজান্তেই ভালোবাসার অনাগত শিশুকে নিয়ে ফাল্লাচি বারবার ভেবেছেন। ভ্রুণ থেকে পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত তিনি তার অনাগত শিশুর সাথে প্রতিদিন কথা বলেছেন। সে কথায় উঠে এসেছে এই অমানবিক পৃধিবীর বৈষম্য-ভেদাভেদের কথা। একজন নারী মা হয়ে উঠতে গিয়ে তার কি পরিমাণ ত্যাগ করতে হয়, তার বিপরীতে একজন পুরুষ কত সহজে বাবা হয়েও বাবা হতে পারেন না তার চিত্রায়নও করেছেন ওরিয়ানা ফাল্লাচি।
এই পৃথিবীতে কেউই অপরিহার্য নয়। যদি হোমার, ইকারুস, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি কিংবা যিশু না জন্মাতেন তবুও এই পৃথিবী ঠিক এভাবেই কি চলতো না? এই প্রশ্নও নিজেকে করেছেন ফাল্লাচি। শেষ পর্যন্ত তিনি তার অনাগত শিশুকে পৃথিবীতে আনতে চেয়েছিলেন বা চাননি।
বইটির শেষ প্যারা হুবুহু তুলে দিয়ে আজকের লেখা এখানেই শেষ করবো। পাঠক মাত্র ৪৭ পৃষ্ঠার বইটি সম্পর্কে খুব বেশিক্ষণ বোধয় বকবক করে ফেলেছি।
আর আমাদের এখানে প্রয়োজন নেই। তুমি মরে গেছ, আমিও বোধহয় মরে যাচ্ছি। কিন্তু তাতে কিছুই এসে যায না। জীবন ধারাবাহিক। জীবনের কখনো মৃত্যু নেই।
ভালো রিভিউ দিয়েছো শিপ্ত। ধুম করে পড়ে ফেললাম