গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন, সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার

শিপ্ত বড়ুয়া

গ্রাম পাঠাগার আমাদের বর্ণনা করার মতো অসংখ্য স্মৃতির সাক্ষী। একজন ব্যক্তির স্মৃতির পাতায় গ্রাম শব্দটি না থাকলে স্মৃতিগুলো কেমন জানি ফেকাসে হয়ে যায়।অনেক দিনের স্বপ্ন ছিলো একটা পাঠাগার করবো এবং গ্রামের সাধারণ ছেলে-মেয়েরা পাঠাগারে নানান বই পড়বে এবং জ্ঞান অর্জন করবে, অবশেষে আমরা আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছি। বিশেষ করে গ্রামে গ্রামে তেমন একটা পাঠাগার দেখা যায় না।

সারা বাংলাদেশ ঘুরলে আপনি হাতে গোনা কয়েকটি গ্রামে পাঠাগার দেখতে পাবেন। কিন্তু প্রত্যেক গ্রামে পাঠাগার গড়ে তোলা খুবই প্রয়োজন। গ্রামের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েদের পরিবার গরীব এবং সঠিক নির্দেশনাবিহীন যার ফলে তারা তাদের স্কুল-কলেজের নির্ধারিত সিলেবাসের বই ছাড়া তেমন কোন বই-ই পড়তে পারে না।

কিন্তু সিলেবাসভিত্তিক অল্প কিছু বই ছাড়া সাহিত্য-বিজ্ঞান এবং নানান বিষয়ের বই পড়তে না পারলে একজন ছাত্র কিংবা ছাত্রী কখনোই নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে না, অনেক জানার বিষয় থেকেই সে বাদ পড়ে যায়।

সুতরাং নিজেকে আরো জানার জন্য, বিজ্ঞানের নানান বিষয় জানার জন্য একটি পাঠাগার তথা বিশাল বইয়ের ভান্ডারের দরকার আছে। সমাজের উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা পালন করে তরুণ সমাজ, কিন্তু সে তরুণ সমাজের মনন-মগজের উন্নতকরণের কাজটি করতে পারে সাহিত্য ও বিজ্ঞান শাখার বিভিন্ন বই। সে বইগুলো একসাথে একজায়গায় করাটাই হলো একটি পাঠাগারের সৃষ্টি।

পাঠাগার মানেই শুধু বই পড়ার মাধ্যমে আনন্দ লাভ কিংবা নিজেকে আবিষ্কার করা নয় বরং সমাজের সঠিক দিকগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন গ্রামের মানুষ কেমন জানি এখনো আদিকালের ভ্রান্ত নানান ধারণা নিয়ে বসবাস করে।

শুধু যে গ্রামের মানুষ এমন, শহুরে মানুষগুলো আধুনিক চিন্তাধার নিয়ে বসবাস করে এমনটাও নয়। বেশিরভাগ মানুষ এখনো সেকেলে এবং আদিম চিন্তা-ধারণা নিয়ে বসবাসের একমাত্র কারণ কিন্তু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা না করা এবং সঠিক সু-শিক্ষার অভাব। মানুষ সুচিন্তা করবেই বা কিভাবে, যদি সুযোগ না পায়।

আমরা অনেকেই মানুষের অধিকার নিয়ে সচরাচর মাঠে মিছিল করতে নেমে পড়ি এবং জনসাধারণকে আহবান জানাই আমাদের সাথে আন্দোলনে যোগদান করার অথবা নানান কৌশলে চেষ্টা করে যাই কিভাবে জন-মানুষকে আমাদের সাথে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আনা যায়। কিন্তু আমরা একবারো ভাবি না মানুষ এখনো তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন হতে পারে নি। বেশিরভাগ মানুষ এখনো বুঝে না কোনটি ভালো আর কোনটি খারাপ।

সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্ক্স প্রথমেই বলেছিলেন, ”মানুষের অধিকার আদায়ের প্রধান এবং প্রথম শর্ত হলো তত্ত্ব এবং প্রয়োগের সমান মিল” রাখা। তত্ত্ব এবং প্রয়োগের মিল রাখা মানেই মানুষকে আগে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হতে হবে তারপর প্রয়োগের ফলাফল আসবে। এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হতে পারে বই পড়ার মাধ্যমে।

বাংলাদেশে সর্বশেষ হিসাব মতে ৬৪,০০০ গ্রাম আছে। এই চৌষট্টি হাজার গ্রামের মধ্যে ষাট হাজার গ্রাম পাঠাগার স্থাপন করার উপযোগী। এবং এক গ্রাম থেকে একজন বই পড়ুয়া এ উদ্যেগ চাইলে খুব সহজেই নিতে পারে। একটি পাঠাগারের প্রধান উপাদান বই।

এই আধুনিক যুগে বই সংগ্রহ করা কোন ব্যাপার না।খুব সহজেই ফেসবুক এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বই দিয়ে সাহায্যের আবেদন করা যায়।আমরা নিজেরাও আমাদের পাঠাগার স্থাপন করেছিলান বই ভিক্ষা করে।

বাংলাদেশে অনেক মানুষ আছেন যারা পাঠাগারের সাহায্যে এগিয়ে আসতে চান কিন্তু পারেন না।গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন নামে যে সংগঠনটি আছে সে সংগঠনের সাহায্যে চাইলে পরামর্শ করে কিভাবে একটি পাঠাগার করা যায় সে বিষয়টি জেনে নেওয়া যায়।

ষাট হাজার গ্রামে যদি পাঠাগার স্থাপন করা যায় এবং একই সাথে পাঠ কার্যক্রম চালানো যায় তাহলে এই বাংলাদেশের কাঠামো সু-সুসংগঠিত হতে খুব বেশি সময়ের দরকার হবে না।

ষাট হাজার গ্রামে একই সময়ে মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা মানেই অপরাধ, কু-সংস্কার এবং কু-প্রথা দূর হওয়া। আর এইসব দূর হলেই একটি দেশ বিদ্যুতের গতিতে বদলে যাওয়া বিশাল বিষয় নয়। একজন ব্রিটিশ কবি বলেছিলেন “বই পড়া মানে গত সময়ের সেরা মানুষদের সাথে আলাপ করা ”। মানুষ নিজেদের চিন্তাধারা যখন অন্যদের সাথে মনে মনে পরিবর্তন করবে সে মানুষ ভালো-খারাপের পার্থক্য বুঝতে বাধ্য।

একটি গ্রামে পাঠাগার গড়ে তোলা মানেই শুধু বই পড়া নয় সাথে সাথে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সমাজের উপর প্রভাব ফেলা। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন  “সাংস্কৃতিক মুক্তি ছাড়া মানুষের রাজনৈতিক মুক্তি মিলে না”।

সুতরাং বুঝা যায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন সমাজ পরিবর্তনের আরো কি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।একটি পাঠাগারের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন একসাথে খুব সুন্দরভাবেই হয়।

একটি পাঠাগারের মাধ্যমে গ্রামে বই পড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, খেলা-ধুলার আয়োজন করা যায়। গ্রামের আশু সমস্যা সমাধানের জন্য হলেও প্রত্যেক গ্রামে একটি করে পাঠাগার গড়ে তোলা দরকার। অনেকের ইচ্ছে আছে গ্রামে পাঠাগার করার, কিন্তু কিভাবে একটি পাঠাগার গড়ে তুলতে হবে সে বিষয়ে জানেন না, এক্ষেত্রে আপনি গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন কিংবা পাঠাগার সৃষ্টি করেছে এমন কোন ব্যক্তির কাছ থেকেও পরামর্শ নিতে পারেন। তখন আপনার পাঠাগার করার স্বপ্ন অর্ধেক বাস্তবায়িত হবে। দেশকে সুন্দর এবং সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন করতে হলে গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের বিকল্প নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *