গৌতম বুদ্ধের শেষ বাণী

শিপ্ত বড়ুয়া

‘যখন আমি মারা যাবো, আমার শিক্ষা তোমাদের শিক্ষক ও পথ নির্দেশক হয়ে থাকবে।’

গৌতম বুদ্ধ তাঁর মহাপরিনির্বাণের তিন মাস আগে শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন; “আমি গত ৪৫ বছর ধরে সকল নৈতিক শিক্ষা এবং আমার সারাজীবনের লব্দ জ্ঞান তোমাদের কাছে প্রচার করেছি। যা তোমাদের সম্পদ এবং এগুলোকে তোমাদের ভালো করে আয়ত্ব করা উচিৎ হবে।

এসব শিক্ষা তোমরা নিজেদের জীবনে চর্চা করবে এবং অন্যদের কাছে এসব পৌঁছানো তোমাদের দায়িত্ব। আমার তোমাদেরকে দেওয়া প্রশ্নের উত্তর এবং নৈতিক শিক্ষাগুলো সমাজে সুষ্ঠুভাবে বসবাস করতে সহায়তা করবে এবং পরেও যারা পৃথিবীতে আসবে তাঁদের মঙ্গলের জন্যও এসব দরকার হবে হয়তো।”

‘আমার বয়স শেষ পর্যায়ে; জীবনের আয়ু খুবই কম। কিছুদিন পরেই হয়তো আমি মারা যাবো, তোমাদের ছেড়ে এ পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। তখন তোমাদের অবশ্যই ধৈর্য্যশীল হতে হবে। হে ভিক্ষুগণ, মনকে পবিত্র এবং খাঁটি রাখবে সবসময়, নিয়মিত জ্ঞান অর্জনে মত্ত থাকো! যারা নিরলসভাবে জ্ঞান অর্জন করতে থাকে এবং সত্যের সন্ধান করে, তাঁরা জন্ম-মৃত্যুর ভবচক্র থেকে মুক্ত হতে পারে এবং ঠিক এভাবেই দুঃখের পরিসমাপ্তি ঘটে।

এসবের পর যখন আনন্দ বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন যে, হে বুদ্ধ আপনি মারা যাওয়ার পর এতগুলো শিষ্য ভিক্ষুর নিয়ন্ত্রণ কে করবে? তাঁদের পরিচালনা কে করবে? কে নেতৃত্ব দিবে?

বুদ্ধ আনন্দকে তাঁর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে কি ধরণের নিয়ন্ত্রণ আশা করো আনন্দ? আমি সত্যের প্রচার করেছি মাত্র এবং কখনো কোনকিছু নিয়ন্ত্রণ করিনি, বৈষম্যহীনভাবে কেবল তা করেছি; সত্যকে অন্বেষণ এবং প্রচারের জন্য কোন নিয়ন্ত্রণের দরকার হয় না, নেতৃত্বেরও দরকার নাই….’

আনন্দ, এমন হতে পারে যে, তোমার মতো অন্যদেরও এমন অনেক চিন্তা আসবে যে, “গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন ওনি মারা যাওয়ার পর দ্রুতই অর্থহীন হয়ে যাবে; শীগ্রই আমাদের পথ নির্দেশক বুদ্ধ আমাদের মাঝে আর থাকবেন না।” আনন্দ, এরকম চিন্তার কিন্তু কখনোই উদ্রেগ করো না। ‘যখন আমি আর থাকবো না, আমার প্রচারিত দর্শন এবং শিক্ষা ও নীতি অবশ্যই তোমাদের সাথে থাকবে, পথ দেখাবে তোমাদের গুরুর মতো।’

গৌতম বুদ্ধ আরো গভীর বিশ্লেষণ দিতে গিয়ে বললেন: আমার শিষ্যদের মধ্য থেকে যদি এখানে কেউ মনে করে, ‘শুধুমাত্র আমিই সবসময় তোমদের ভ্রাতৃত্ববোধের নেতৃত্ব দেবো’, অথবা ‘তোমাদের সকল জীবন চর্চা ও প্রদত্ত শিক্ষা আমার উপর নির্ভরশীল এবং আমাকে ছাড়া অচল’ ও ‘এটা আমিই, যে কিনা শুধুমাত্র তোমাদের মুক্তি দিতে পারি’, তাহলে ভুল।

আমি কিন্তু কখনোই এমন মনে করি না যে, আমাকেই সবসময় আমার প্রদত্ত দর্শন ও জীবন চর্চার নীতিকে পরিচালনা করতে হবে অথবা পাহারা দিতে হবে, এমনও নয় যে, আমাকে ছাড়া তোমাদের নিজেদের জীবনে এসবের বাস্তবায়ন অসম্ভব। আমার প্রদত্ত দর্শনের বাস্তবায়ন কেবল আমার উপর নির্ভরশীল নয়। আমি আমার জীবনের অন্তিম পর্যায়ে চলে এসেছি। ঠিক জরাঝীর্ণ একটি মালবাহী গাড়ির মতো এখন আমার দেহ, যা অতি-যতœসহকারে কোনমতে চলছে।

সুতরাং, আনন্দ তোমরা নিজেরা নিজেদের প্রদীপ হও এবং নিজের কাছে আশ্রয় নাও। কখনোই অন্যকারো আশ্রয় খুজোঁ না। কেবল সত্যকে তোমাদের হাতের মশাল বানিয়ে চরম অন্ধকার পথ পাড়ি দাও এবং কেবল সত্যই হোক তোমাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। কখনোই নিজের কাছে ছাড়া অন্যকোথাও আশ্রয় চাইও না।

বুদ্ধের আঁশি বছর বয়সে, তাঁর জন্মতিথিতে তিনি পার্থিব জগতে কোনপ্রকার অতিপ্রাকৃত শক্তি ছাড়া স্বাভাবিকভাবে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। তিনি নিজের জীবন চর্চা থেকে প্রাপ্ত সত্যিকারের প্রকৃত দর্শনকে আমাদের দেখিয়েছেন, জোর করে কোনকিছু তিনি চাপিয়ে দেন নি, এমনকি জীবদ্দশায় তিনি এভাবে তাঁর জীবন চর্চা করেছেন।

বুদ্ধ যখন নির্বাণপ্রাপ্ত হলেন, তাঁর একজন শিষ্য মন্তব্য করেছিলেন, “সবাইকে জগত ছেড়ে চলে যেতে হবে, অপার্থিব হবে Ñ সকল প্রাণীর জীবনে মিশ্রিতভাবে ক্রমানুসারে মৃত্যু আসবেই। হ্যাঁ, এমনকি একজন মহাব্যক্তি হলেও, ‘আমাদের পথ নির্দেশক গৌতম বুদ্ধের, এক অতুলনীয় ব্যক্তির, জ্ঞানে পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ এবং নিজে আলোকিত’ তাঁরও অবশ্যই দেহ ত্যাগ করতে হয়েছে।

‘কায়মনোবাক্যে কাজ করো, জগতে সমস্ত কিছুই অস্থায়ী’।
(মহাপরিনির্বাণ সূত্র)

Archetype : K. Sri Dhammananda, What Buddhist Believe (Fifth Edition 1993, budaedu), (The Last Message of the Budhha, 39.)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *