শিরুপন বড়ুয়া
ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত কুশিনগর হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের চারটি মহাতীর্থ অর্থাৎ চারটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থানের একটি, যা প্রাচীন ভারতের ১৬টি মহা জনপদের একটি এবং মল্লদের রাজধানী। এখানেই গৌতম বুদ্ধ পরলোক গমন করেন, যাকে বৌদ্ধ ধর্মে মহাপরিনির্বাণ বলা হয়। বাঙ্গালী হিসেবে আমাদের গর্বের বিষয় এটাই যে, ৭০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৪০০ শত বছর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা থেকে শুরু করে ভারতের উত্তর প্রদেশের বিশাল এলাকা বাংলার পাল বংশের শাসনাধীন ছিল।
পাল সাম্রাজের সীমানা এই রাজবংশের ২য় স¤্রাট ধর্মপাল এবং তাঁর পুত্র ৩য় সম্রাট দেবপালের সময় পাকিস্তান এবং আফগানিস্থান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ভারতবর্ষের বৌদ্ধ সভ্যতার অনেক মূল্যবান স্থান যেমন, গুপ্তযুগে নির্মিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, বৌদ্ধগয়ার মহাবোধি বিহার, কুশিনগর, সারনাথ ইত্যাদি এলাকা এই রাজবংশের সরাসরি অধীনে থেকে পৃষ্টপোষকতা লাভ করে। শুধু তাই নয়, এই রাজবংশের প্রথম শাসক সম্রাট গোপাল নির্মাণ করেন ওদন্তপুরি বৌদ্ধ বিহার, ২য় সম্রাট ধর্মপাল নির্মাণ করেন বিখ্যাত বিক্রমশীলা মহাবিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়, এবং সোমপুর বা পাহাড়পুর বৌদ্ধ মহাবিহার।
১১০০ খ্রিস্টাব্দে পাল বংশ সেন বংশের হাতে ক্ষমতা হারানোর পর বৌদ্ধ ধর্ম এবং এই ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক স্থানগুলো গুরুত্ব হারাতে থাকে। এক পর্যায়ে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের পর ভারতে মুসলমান শাসনামলে ঐসব স্থানগুলো ধ্বংস হয়ে কালেরস্রোতে ধুলোয় ঢাকা পড়ে। বৌদ্ধ ধর্ম তার নিজ জন্মভূমি থেকেই উচ্ছেদ হয়ে যায়। এমনকি বৌদ্ধ গয়ার মহাবোধি বিহারটিও ওখানকার হিন্দু পুরোহিতদের দখলে চলে যায়। কিন্তু ১৮০০ শতকে ব্রিটিশ আমলে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে বৌদ্ধ সভ্যতার চিহ্নগুলো মাটির নিচ থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে শুরু হয় বৌদ্ধ ধর্মের পুনঃজাগরণ। বৌদ্ধ ইতিহাসে যা “Revival of Buddhism in modern India” নামে পরিচিত।
১৮৬১ সালে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের হাত ধরে Archaeological Survey of India বা সংক্ষেপে অঝও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৮৭৬ সালের দিকে ভারতের কুশিনগরে আলেকজান্ডার কানিংহাম এবং সি এল কার্লাইল প্রাথমিকভাবে কিছু খনন কার্য চালান। পরবর্তীতে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ভোগেল কুশিনগরে ব্যাপক খনন কার্য পরিচালনা করেন।
আর ঠিক ঐ সময়টাতেই কুশিনগরে নতুন একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের উদ্যোগ নেন ভিক্ষু মহাবীর মহাথেরো, তিনি আধুনিক ভারতের প্রথম বৌদ্ধ ভিক্ষু যিনি হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে ছিলেন। তিনি ব্যক্তি জীবনে একজন স্বনামধন্য কুস্তিগির ছিলেন। নামের মধ্যেই সেই বিষয়টি লক্ষণীয়। ইনি ১৮৯০ সালে শ্রীলংকা সফরে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়ে ভিক্ষু হন, এবং ১৮৯১ সালে ভারতে ফেরত আসেন।
তারও অনেক পরে ১৯০২ সালে দানবীর খিজারী’র অর্থায়নে ভারতের কুশিনগরে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ স্তুপের পাশেই একটি বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করেন। লেখক Chan Khoon San এর “Buddhist Pilgrimage” বইটিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। ভিক্ষু মহাবীর তখন কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। তাঁর কলকাতার আবাসস্থল এবং রামুর সন্তান উ খিজারী’র কলকাতার বাসা কাছাকাছিই ছিল। আর তাই এই দু’জনের মধ্যে দারুণ এক সখ্যতা গড়ে উঠে।
ভিক্ষু মহাবীরের কুশিনগরে বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে কিন্তু একটা কারণও ছিল। ১৮৯১ সালে শ্রীলংকার অনাগরিকা ধর্মপাল এবং ব্রিটিশ সাংবাদিক ও কবি ঊফরিহ অৎহড়ষফ দুজনে মিলে শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে গড়ে তোলেন Maha Bodhi Society। সে বছরই সোসাইটির প্রাধান কার্যালয় কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। অনাগরিকা ধর্মপাল এরপর থেকে বৌদ্ধ গয়ার মহাবোধি টেম্পল হিন্দু পুরোহিতদের দখল থেকে উদ্ধারের কাজে জড়িয়ে পড়েন।
তিনি যখন সেখানে ব্যস্ত, তখন ভিক্ষু মহাবীর ভাবলেন একই ভাবে কুশিনগরের মহাপরিনির্বাণ টেম্পলটিরও দখলে নেয়া দরকার, যাতে বৌদ্ধরা আবারো সেখানে প্রার্থনা শুরু করতে পারে। অবশ্য এটাই একমাত্র কারণ ছিল না। ঠিক ঐ সময়ে ভারতের বুদ্ধ গয়ায় মহাবোধি টেম্পলের কাছেই অবস্থিত বার্মিজ ধর্মশালা সংক্রান্ত বিষয়ে স্থানীয়দের দ্বারা আরাকানিজ বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীরা হামলার স্বীকার হয়, পরে এই ঘটনা নিয়ে মামলাও হয়।
বুদ্ধ গয়ায় অনাগরিকা ধর্মপালের সরব উপস্থিতির পরও আরাকানিজদের উপর এমন হামলায় খিজারী খুব ব্যথিত হন, এবং ভদন্ত মহাবীরও একই সময়ে কুশিনগরে বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে এই দানবীরের সাথে দেখা করেন। দুজনেই অনাগরিকা ধর্মপালের হস্তক্ষেপ ছাড়া কুশিনগরের পরিনির্বাণ টেম্পল সংস্কার এবং এর পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চাইলেন।
কুশিনগরে খিজারী কর্তৃক বিহার নির্মাণের বিষয়টি পরবর্তীতে প্রায় আঠারো-উনিশ বছর পর অনাগরিকা ধর্মপাল কর্তৃক সম্পাদিত “মহাবোধি” জার্নালে প্রকাশিত হয়, “The wealthy Buddhist U Khee Zarhee of Calcutta began helping the Bhikkhu Mahavira to improve the hallowed spot [Kushinagar], and thanks to his generosity, the place has now a monastery built for the use of monks, and a dharmashala for the use of laymen” (The Maha Bodhi & the United Buddhist World, Vol.29, 1921, page 148)
এই তথ্যটি Douglas Fairchild Ober এর ”REINVENTING BUDDHISM: CONVERSATIONS AND ENCOUNTERS IN MODERN INDIA, 1839-1956” ১৮৩৯-১৯৫৬’ বইটিতে পাওয়া যাবে (পৃষ্ঠা ১৫৯)। মহাবোধি জার্নালে উপরোক্ত খবরটি প্রকাশিত হওয়ার আরো দুই বছর পর ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেকে দানবীর খিজারী কুশিনগরে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ পরিচালনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ সহায়তা প্রদান করেন, যা পরে আলোচনা করব।
যাই হোক, মহাবীরের এই কাজে উ খিজারী আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ১৮৯৮ সালে খিজারী তৎকালীন মুদ্রায় নগদ এক হাজার টাকা তুলে দেন ভিক্ষু মহাবীরের হাতে। এই দানের কথা অনাগরিকা কর্তৃক সম্পাদিত এবং ১৯২১ সালে প্রকাশিত “The Mahabodhi Journal Vol. 29 .” ২৯ এর ১৪৮ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল ঐ টাকাতে কুশিনগরে নতুন বিহারের জন্য ৫ একর ভূমি ক্রয় করা।
স্থানীয় জমিদারের সাথে জমির দরদামও ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু টাকা নিয়ে কলকাতা থেকে কুশিনগর যাওয়ার পথে দিউর (Deor) নামক স্থানে মহাবীরকে ডাকাত দল আক্রমণ করে সব টাকা ছিনিয়ে নেয়। মহাবীর তখন কুশিনগর থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে অবস্থান করছিলেন।
পরে অবশ্য খিজারী তাঁকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করা সহ আরো ১০০০ টাকা পাঠিয়ে দেন ভিক্ষু মহাবীরের কাছে। ১৯২২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমার সংকলিত “বংশ পরিচয় (২য়)” গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, খিজারী সর্বমোট ২০,০০০ টাকা খরচ করেছিলেন কুশিনগরে বৌদ্ধ বিহারের জায়গা ক্রয়, বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ এবং ধর্মশালা নির্মাণের জন্য। এছাড়াও প্রতিমাসে কলকাতা থেকে কুশিনগরে অবস্থানরত ভিক্ষুদের জন্য ১০০ টাকা মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দিতেন (পৃষ্ঠা ৮২)।
ইতিমধ্যে কলকাতায় খিজারী’র সাথে আরো দুজন গুরুত্বপূর্ণ ভিক্ষুর বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। তার মধ্যে একজন হলেন চট্টগ্রামের সন্তান ভিক্ষু কৃপাশরণ মহাথেরো, যাঁর জন্ম ১৮৬৫ সালে চট্টগ্রামের উনাইনপুর গ্রামে, এবং অন্যজন আরাকানের শ্রমণ (ভিক্ষু হওয়ার প্রথম ধাপ) শিন চন্দ্র (পরবর্তীতে ভিক্ষু উ চন্দ্রমনি,যিনি ভারতের সংবিধান প্রণেতা ডঃ আম্বেদকারকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা দিয়েছিলেন)।
‘বেঙ্গল বুড্ডিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ কলকাতাতে তো বটেই, সারা ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের পুনঃজাগরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। কৃপাশরণ মহাথেরো ১৮৯২ সালে কলকাতায় বেঙ্গল বুড্ডিস্ট এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ‘বৌদ্ধ ধর্মাংকুর সভা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
খিজারী এই এসোসিয়েশন গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন, এবং উক্ত সংগঠনের একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন, যা ১৯১৩-১৯১৪, এবং ১৯১৬-১৯১৭ সালের প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশনা থেকে জানা যায়। তাছাড়া কৃপাশরণ মহাথেরো’র স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ জনহিতকর বিভিন্ন সামাজিক কাজে অন্যতম একজন অর্থ দাতা হয়ে উঠেন খিজারী। (Hundred Yers of Bauddha Dharmankur Sabha [Bengal Buddhist Association] 1892-1992, page 4)।
১৯৯০ সালে বৌদ্ধ ধর্মাংকুর সভা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হওয়া Jagajjyoti Kripasharan Mahathera 125th Birth Anniversary Volume, 1990 থেকে জানা যায়, ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে কৃপাশরণ মহাথেরো যখন বৌদ্ধ তীর্থ শ্রাবস্তির উদ্দেশ্যে ভ্রমণের উদ্যোগ নেন, তখন দানবীর খিজারী কৃপাশরণের ভ্রমণের সকল ব্যয়ভার বহন করেন।
কৃপাশরণ মহাথেরোর সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর এতটাই ভালো সম্পর্ক ছিল যে, ভিক্ষু কৃপাশরণের অনুরোধে চট্টগ্রামের অন্তত দশটি ঐ.ঊ ঝপযড়ড়ষ বা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভ করে। ওদিকে আরাকানিজ শ্রমণ শিন চন্দের সাথে খিজারী’র কাহিনীটি রামুবাসির জন্য আরো চমকপ্রদ।
Calcutta University কর্তৃক ১৯৯০ সালে প্রকাশিত “History of Buddhism in Arakan” বইটি থেকে জানা যায়, ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে শ্রমণ অবস্থায় শিন চন্দ্র (পরবর্তীতে ভিক্ষু উ চন্দ্রমনি) কলকাতায় খিজারী’র বাসায় গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেন। এরপর বিভিন্ন সাক্ষাতে উ খিজারী এবং শ্রমণ শিন চন্দ্রের মধ্যে একটি ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে।
বিশেষ করে শিন চন্দ্রের মধ্যে মানবতার জন্য কাজ করার আকুলতা অভিজ্ঞ খিজারী’র চোখে অচিরেই ধরা পড়ে। ঠিক একই ধরনের বর্ণনা Chan Khoon San এর Buddhist Pilgrimage বইটিতেও পাওয়া যায়। ২০০২ সালে ভারতের সারনাথ থেকে প্রকাশিত The Life Story of Sri Bhaddhanta Chandramani Mahathera বইটি থেকে জানা যায়, ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে দানবীর উ খিজারী তাঁর ছোট ভাই দ অং, স্ত্রী ড মি চ্যান, ছেলে ক্যা যান হ্লাকে (অন্য ছেলে কিয়াও হটুনের তখনো জন্ম হয়নি) সাথে নিয়ে রামুতে আসেন শ্রমণ শিন চন্দ্রকে উপসম্পদা বা ভিক্ষু করানোর উদ্দেশ্যে।
খিজারী অনেক অর্থ খরচ করে উক্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ঐ অনুষ্ঠানে তৎকালীন বার্মার স্বনামধন্য ভিক্ষুসহ ভারতের অনেক ভিক্ষুও উপস্থিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, ঐ অনুষ্ঠানে খিজারী’র ছেলে ক্যা যান হ্লাও শ্রমণ হন (সকল বৌদ্ধ পুরুষদের জীবনে অন্তত একবার শ্রমণ হতে হয়। যাকে শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা নেয়া বলে)। এই ঘটনাটির বর্ণনা লেখক অসিন সিরি ওকানথা’র “History of Buddhism in Arakan” বইটি থেকেও পাওয়া যায়। শ্রমণ শিন চন্দের নতুন নাম দেয়া হয় ভিক্ষু উ চন্দ্রমনি। আর অমাদের রামু থেকেই শুরু হয় ভদন্ত উ চন্দ্রমনি’র কর্মময় জীবনের যাত্রা, এবং খিজারী’র কল্যাণেই রামুবাসীর নাম চিরদিনের জন্য সেই ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে যায়।
এই সেই বিখ্যাত ভিক্ষু উ চন্দ্রমনি যিনি ভারতের সংবিধান প্রণেতা এবং দলিত সম্প্রদায়ের নেতা ডঃ আম্বেদকারকে কয়েক লক্ষ অনুসারীসহ বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা দিয়ে ছিলেন। ১৯৯১ সালে কলকাতা বৌদ্ধ ধর্মাংকুর সভা থেকে প্রকাশিত “Jagajjyoti: Dr.Babasaheb Ambedkar Birth Centenary Volume” এ উল্লেখ আছে যে, ঘটনাটি ঘটে ১৯৫৬ সালের ১৪ই অক্টোবর। বৌদ্ধ ধর্মের কল্যাণের জন্য খিজারী’র সম্ভবত সবচেয়ে বড় আবদান হচ্ছে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ বা পরলোক গমনের স্থান কুশিনগরে খনন কার্য পরিচালনা ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করার লক্ষ্যে Archaeological Survey of India কে অর্থ প্রদান করা।
Calcutta Government of Indian Central Publication Branch কর্তৃক প্রকাশিত “Annual Report of the Archaeological Survey of India, 1923-1924” থেকে জানা যায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দানবীর খিজারী প্রথম দফায় তৎকালীন মুদ্রায় পাঁচ হাজার টাকা কুশিনগরের বৌদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খনন কার্য পরিচালনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গোরকপুর সরকারি রাজস্ব অফিসে জমা করেন।
পরবর্তীতে সংস্থাটির ১৯২৪-২৫ সালের রিপোর্টে খিজারী’র প্রদান করা অর্থের ব্যয়ের কথা উল্লেখ করা হয়। এবং এর জন্য ব্রিটিশ সরকার উ খিজারী’র কাছে কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন। বর্তমানে কুশিনগরে মিয়ানমার বৌদ্ধ বিহারটি যে জায়গায় অবস্থিত, তা সম্পূর্ণ খিজারী’র দানকৃত অর্থে ক্রয় করা হয়। শুধু তাই নয়, মিয়ানমার বিহার কমপ্লেক্সের ভেতরে দ্বিতল পুরনো বিহারটি নির্মাণের জন্য উ খিজারী সমস্ত ব্যয় বহন করেন।
১৯৪৮ সালে The Maha Bodhi Society of Ceylon (Sri Lanka) কর্তৃক প্রকাশিত Devapriya Valisinha কর্তৃক রচিত “Buddhist Shrines in India ” গ্রন্থে খিজারী কর্তৃক কুশিনগরে নির্মিত ধর্মশালার কথা উল্লেখ আছে। ২০১৭ সালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল খিজারী’র এসব কীর্তি স্বচক্ষে দেখার। ওখানে খিজারী’র একটি ভাস্কর্যও রাখা আছে।
The Life Story of Sri Bhaddhanta Chandramani Mahathera বইটিতে উল্লেখ আছে যে, ১৯০১ সালে ভিক্ষু চন্দ্রমণি এবং উ খিজারী কুশিনগরে অবস্থিত মহাপরিনির্বাণ টেম্পলে বৌদ্ধদের ধর্মীয় কাজ আবারো শুরু করার অনুমতি চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেন। সে আবেদনটি মঞ্জুর করা হয়। এখনও এর সুফল দুনিয়ার সকল বৌদ্ধরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছে। ঠিক একই ধরনের বক্তব্য “Chan Khoon San” এর “Buddhist Pilgrimage (new edition 2009)” এর ৪৪ নং পৃষ্ঠাতেও পাওয়া যায়।
১৯১৯ সালের মার্চ মাসে উ খিজারী কর্তৃক ভারতের কুশিনগরে নির্মিত বৌদ্ধ বিহারে ভিক্ষু মহাবীর ৮৫ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। খিজারী তাঁর ধর্মীয় গুরুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য তৎকালীন মুদ্রায় এক হাজার টাকা দান করেন, এবং মহাবীরকে রাজকীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় জানান।
বর্তমানে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণ বা পরলোক গমনের স্থান ভারতের উত্তর প্রদেশের কুশিনগরে বেড়াতে এবং ধর্মীয় কাজে আসেন। নানান দেশের শত শত পর্যটক এবং তীর্থযাত্রীরা কুশিনগরের যেসব প্রত্নস্থল যেমন, পরিনির্বাণ টেম্পল, তার পেছনেই লাগোয়া পরিনির্বাণ স্তূপ এবং মাতাকুয়ার বিহারের গুপ্ত যুগের প্রাচীন বুদ্ধ মূর্তি আজকে যে অবস্থায় দেখছেন, এসব কিছুরই বেশিরভাগ মূলত Archaeological Survey of India বা ASI এর মাধ্যমে খিজারী’র আর্থিক সহায়তায় সংস্কার করা হয়েছে।
এই মহান দানবীর নিজে অর্থ সহায়তা করে ক্ষান্ত হননি, তৎকালীন বার্মা থেকে বিভিন্ন দাতাদের কাছ থেকে ১৩,০০০ (তের হাজার) টাকা সংগ্রহ করে ভিক্ষু মহাবীরের হাতে তুলে দেন। পরে সেই অর্থে কুশিনগরে স্কুল নির্মাণ করা হয়।
বর্মি রাজা মিন্ডন কর্তৃক ভারতের বিহার প্রদেশের বৌদ্ধগয়ায় স্থাপিত বার্মিজ ধর্মশালার দখল নিয়ে হিন্দু পুরোহিত এবং রাখাইনদের মধ্যে একটি মামলা কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। সে মামলার খরচ চালানোর জন্য কলকাতায় অবস্থিত বৌদ্ধদের মধ্যে সর্বপ্রথম আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন খিজারী। ১৯০০ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত খিজারী নিয়ম করে উক্ত মামলার খরচ বাবদ ২০ টাকা প্রদান করতেন।
উক্ত মামলার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বার্মা থেকে আগত প্রতিনিধি এবং আইনজীবীরা কলকাতায় আসলে তাঁরা খিজারী’র ইডেন হসপিটাল রোডের বাসাতে উঠতেন। রেঙ্গুন থেকে জাহাজে করে কলকাতায় আসা এসব প্রতিনিধিদের উ খিজারী কলকাতায় বসবাসরত চট্টগ্রামের বড়ুয়া এবং রাখাইন ছাত্রদেরকে সাথে নিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতেন। সেরকম একটি বর্ণনা মহাবোধি জার্নালে পাওয়া যায়।
গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের স্থান ভারতের উত্তর প্রদেশের কুশিনগরে অবস্থিত মহাপরিনির্বাণ টেম্পল এবং তার ঠিক পেছনে পরিনির্বাণ স্তূপ। কয়েক শতকের বিরতির পর ১৯০১ সালে দানবীর খিজারী এবং ভিক্ষু চন্দ্রমণি’র আবেদনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বৌদ্ধদের আবারো এখানে প্রার্থনা করার অনুমতি প্রদান করে, যা এখনো চালু আছে। ব্রিটিশ আমলে উ খিজারী এই দুটি স্থাপনাসহ কুশিনগরের শতাব্দী প্রাচীন মাথাকুয়ার বিহারটিও সংস্কার করেন। (এই লেখায় ছবি যুক্ত হবে)।
তথ্যসূত্র:
- Chan Khoon San, Buddhist Pilgrimage, 2nd Edition, (Kuala Lumpur, Malaysia, 2009).
- শীলানন্দ ব্রহ্ম্রচারী, কর্মযোগী কৃপাশরণ, 125th birth anniversary, Volume 1990, (Calcutta).
- Hundred Years of Buddha Dharmankur Sabha, (Bengal Buddhist Association, 1892-1992, Calcutta)
- Ashin Siri Okkantha, History of Buddhism of Arakan, Calcutta University.
- Arthur Burton-Stibbon, A man of religion & Society, Jagajjyoti: Dr. Babasaheb Ambedkar Centenary, (Volume 1991, Calcutta).
- Sir Jhon Marshal (Editor), Annual Report of Archaeological Survey of India, 1923-1924 (Calcutta 1926).
- J.F Blakiston, (Editor), Annual Report of Archaeological Survey of India, 1924-1925.
- Devapriya Valisinha, Buddhist Shrines in India, (The Maha Bodhi Society of Ceylon, Sri Lanka, 1948).
- Nalinaksha Dutta & Krishna Dutta Bakpai, Development of Buddhism in Uttar Pradesh, ( Government of Uttar Pradesh, Lucknow, 1956).
- Diamond Jubilee Souvenir 1891-1951, (Maha Bodhi Society of India, Calcutta, 1951).
- The Maha Bodhi Journal, Vol.61.
- Anagrika Dharmapala, (Editor), The Maha Bodhi & the United Buddhist World, Vol.18, (Calcutta, 1910)