কক্সবাজারের রামু কতটা প্রাচীণ?

রামু

শিরুপন বড়ুয়া

অতীতে চট্টগ্রামের পর রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল কক্সবাজারের রামু উপজেলা। এমনকি আরাকান শাসনামলে রামু ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্র। সে সময় কখনো কখনো এর গুরুত্ব চট্টগ্রামকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। মধ্যযুগে এই রামুতে এসেছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পর্যটক এবং বণিকরা। যাঁদের লেখায় রামু সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। পর্যটক এবং বণিকদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রীক ভূগোলবিদ টলেমি থেকে শুরু করে অনেকের অংকিত মানচিত্রে রামু জনপদটির বৈচিত্র্যময় অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়।

রামু’র প্রাচীনত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কিছু বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এই অঞ্চলের অন্যতম একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান হচ্ছে রামকোট, যার সাথে রামায়ণ এর রাম-সীতার কাহিনী সহ মৌর্য্য যুগের সম্রাট অশোকের নাম জড়িয়ে আছে। রামকোট নিয়ে সাধারণ মানুষের এই ধারনা গুলো যদি ঐতিহাসিক ভাবে সত্য হয়, তবে রামু’র প্রাচীনত্ব টলেমি’র মানচিত্রের বয়সের চেয়ে পুরনো।

রামু’র প্রাচীনত্ব নিয়ে কথা হলে টলেমি’র মানচিত্র সম্পর্কে আলোচনা করতেই হবে। কিন্তু রামু সম্পর্কে স্থানীয়দের মধ্যে অতীতে যাঁরা লিখেছেন,  তাঁরা সবাই টলেমি কর্তৃক রচিত ‘জিওগ্রাফিয়া’ নামক গ্রন্থে থাকা মানচিত্রে রামু’র স্থান পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন মাত্র, বিস্তারিত কিছুই লিখেন নি।

রামু’র অতীত নিয়ে কথা হলে বাংলার প্রাচীন এক রাজ্য হরিকেলের নামও চলে আসবে। কারণ, এখন এটা মনে করা হয়,  চট্টগ্রাম এবং রামু’র রামকোট এক সময় হরিকেল রাজ্যের অংশ ছিল।

এ বিষয়ে বাংলাপিডিয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আরব দেশের বণিকদের লেখায় উঠে আসা রহমী রাজ্যও বাদ যাবে কেন? আরব বণিকদের উল্লেখিত রহম বা রহমী বা রুহমী রাজ্যকে কেউ কেউ মনে করেন আজকের রামু। এছাড়াও রামু’র আরেক নাম ‘রম্যভূমি’ নিয়েও আছে ব্যপক কৌতুহল। রামু’র ইতিহাসে এত বৈচিত্রতা মনে কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়।

তিব্বতি লেখক ও সন্ন্যাসী লামা তারনাথ রম্যভূমি বলতে  কি রামুকে বুঝিয়েছেন? এই রম্যভূমির গুরুত্ব কেমন ছিল? রামকোট এর সাথে রাম-সীতা এবং সম্রাট অশোক এর প্রসঙ্গ কতটা যৌক্তিক? টলেমি’র মানচিত্রে আসলেই কি রামু ছিল? আরব বণিকদের রহমী বা রুহমী বা রহম রাজ্য কি আজকের রামু? রামু’র ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা কিছু ঐতিহাসিক উপাদান বিচার বিশ্লেষণ করলে আমরা অবশ্যই উপরোক্ত প্রশ্ন গুলোর উত্তর পেয়ে যাব।

শুরু করা যাক রম্যভূমি রামু দিয়ে। অনেকেই রামুকে রম্যভূমি রামু বলে থাকেন। এই রম্যভূমি’র ধারনা এসেছে সম্ভবত ঐতিহাসিক লামা তারনাথের লেখা থেকে। লামা তারনাথ ছিলেন একজন তিব্বতি বৌদ্ধ ভিক্ষু। মূলত ‘ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস’ (History of Buddhism in India) গ্রন্থটি রচনার জন্য তিনি বিখ্যাত।

তাঁর মতে বাংলায় পাল শাসনামলে চাঁটিগ্রাম রম্ম বা রম্যভূমি নামে পরিচিত ছিল এবং এর  আরো দক্ষিণের রাজ্যটি পরিচিত ছিল রাখান নামে। যা আজকের আরাকান। তাহলে দেখা যাচ্ছে , তারনাথ শুধু রামুকে নয়, বরং পুরো চট্টগ্রামকেই রম্যভূমি বলেছেন।

তারনাথের গ্রন্থটি ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়। তারও কয়েক দশক আগে ১৫৮৩ থেকে ১৫৯১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারত ভ্রমণ করা রালফ ফিচ তাঁর লেখায় Porto Grande অর্থাৎ চট্টগ্রামকে ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রামের পর রেকন এবং রামে (Kingdom of Recon and Rame) রাজ্যের কথা বলেন, যার রাজা ত্রিপুরা রাজার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী। এখানে Recon হচ্ছে রাখান বা আরাকান, এবং Rame বা রামে হচ্ছে আজকের রামু। Samuel Purchas তাঁর লেখায় রালফ ফিচের kingdom of  Recon and ‘Rame’ এর কথা উল্লেখ করেন। তিনিও ‘Rame’ কে রামু বলেই সনাক্ত করেন।

সুনীতিভূষণ কানুনগো এর মতে রালফ ফিচ আরাকান এবং রামুকে একটি একক রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করায় মধ্যযুগে  রামু’র যে বেশ গুরুত্ব ছিল তা বোঝা যায়।

এদিকে রালফ ফিচের ভারত ভ্রমণের প্রায় অর্ধশত বছর পর রামুতে আসেন ইউরোপীয় পাদ্রি সেবাস্তিয়ান ম্যানরিক। তিনি দিয়াং থেকে আরাকান যাওয়ার পথে ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দের ৫ই জুলাই রামুতে যাত্রা বিরতি করেন, এবং সম্ভবত ৭ই জুলাই রামু ত্যাগ করেন। তাঁর বর্ণনা পড়ার পর এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, ঐ সময় রামু’র গুরুত্ব চট্টগ্রামের চেয়েও বেশি ছিল।

কেননা তিনি রামুকে আরাকানের প্রাদেশিক গভর্নরের আবাসস্থল বলে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে পুরো চট্টগ্রামের রাজস্ব রামু থেকে কালেক্ট করা হতো, এবং বিদেশীরা এখান থেকেই আরাকানে প্রবেশের অনুমতি নিত। তার মানে রালফ ফিচ চট্টগ্রামকে ত্রিপুরার অধীনে দেখে গেলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয় নি।

ম্যানরিক যখন রামুতে আসেন তখন চট্টগ্রাম আরাকানের অধীনে ছিল। ইতিহাসবিদ চৌধূরী শীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধির মতে মগ রাজত্বের সময় রামু চট্টগ্রামের subsidiary head quarter ছিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র ১৯২৪ সালের প্রকাশনা অনুযায়ী চাঁটিগ্রাম ছিল রম্ম বা রম্য দেশের রাজধানী।

ধারনাটি আরো স্পষ্ট হবে ইতিহাসবিদ শরৎ চন্দ্র দাস রায় বাহাদুর কর্তৃক রচিত Antiquity of Chittagong প্রবন্ধটি পড়লে। তাঁর মতে, ত্রিপুরার দক্ষিণে এবং রাখান বা আরাকানের উত্তরে রম্ম বা রম্যদেশ অবস্থিত। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের পর পুরো ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে এই রম্যদেশ।

রম্যদেশের চাঁটিগ্রাম বা চাঁটিগাঁতে একটি বড় বৌদ্ধ বিহার ছিল, যার নাম পন্ডিত বিহার। এই পন্ডিত বিহার যে আজকের চট্টগ্রামে অবস্থিত তা কারো অজানা নয়। শরৎ চন্দ্র দাস মূলত তিব্বতি তথ্যের উপর নির্ভর করে তাঁর নিজের মতামত দিয়েছেন।

তবে এটা সঠিক যে, চট্টগ্রাম একটা সময় বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে।  খ্রীস্টিয় দশম শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষু তিলা যোগী। মগধের প্রধান পুরোহিত নারাতোপা চট্টগ্রামে ভ্রমণ করেন এবং তিলা যোগী’র শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এমনকি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতনের পর অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু তিব্বত, নেপাল এবং চট্টগ্রামেও পালিয়ে আসেন। এসব কারণে চট্টগ্রামের প্রতি তিব্বতিদের আলাদা আবেগ এবং আগ্রহ থাকাটা অমূলক নয়। আর তাই তাদের কাছে চট্টগ্রাম-আরাকান পরিচিতি পায় রম্মদেশ নামে।

কিন্তু আরাকানের ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরাকানিরা রামুকেই রম্যভূমি হিসেবে গণ্য করতো। আরাকানের ইতিহাসে ‘রম্মনগর’ বা ‘রম্যনগর’ বা ‘রামানগর’  বলতে রামুকেই বুঝানো হয়েছে, যা ম্রক উ এর শাসকরা শাসন করতেন। আরাকান রাজারা রামুতে তাঁদের শাসন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও, চট্রগ্রামে সেটা সম্ভব হয় নি।

চট্টগ্রাম হাতবদল হয়েছে অনেকবার। কখনো এর দখল নিয়েছে ত্রিপুরা, আবার কখনো বাংলার সুলতানরা। ত্রিমুখী এই সংঘর্ষের রাজনীতিতে আরাকান রাজারা বেশিরভাগ সময় জয়ী হলেও চট্টগ্রামে তাঁরা রামু’র মতো সফল হতে পারেন নি। তাছাড়া রামু ছিল স্থলপথে বাংলা হতে আরাকানে এবং আরাকান হতে বাংলায় প্রবেশের দরজা। তাই হয়তো আরাকানিদের কাছে রামু ছিল প্রিয় একটি জনপদ, রম্যভূমি।

আসলে রম্যভূমি শব্দটি কখনো রাজনৈতিক ভাবে কোন দেশের জন্য ব্যবহৃত হয়নি। প্রাচীন যুগ বা মধ্য যুগের কোন প্রশাসনিক কাজে এই অঞ্চলের জন্য একটি দেশ হিসেবে এই নামটির ব্যবহার দেখা যায় না। লামা তারনাথ সম্ভবত চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ  দক্ষিণে রামু, এই সমস্ত অঞ্চলের সৌন্দর্যের কথা বিবেচনা করেই রম্যভূমি বিশেষণটি ব্যবহার করেছেন।

সবদিক বিবেচনা করে রম্যভূমি সম্পর্কে আমরা দুটি মতবাদ পাচ্ছি। প্রথমটি হলো, তিব্বতিদের কাছে আজকের চট্টগ্রাম সহ এর দক্ষিণে আরাকান পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল পরিচিত ছিল রম্ম (সংস্কৃতি রম্য) বা ‘রম্যদেশা’ নামে। দ্বিতীয় মতটি হলো, আরাকানের ইতিহাস মতে  শুধু রামুই ‘রম্যভূমি’। আমার নিজের কাছে রম্যভূমি বলতে তিব্বতি ধারনাটাই অধিকতর সঠিক মনে হয়েছে।

রম্যভূমি ছাড়াও রামু’র আরেক নাম প্যানওয়া। বাংলায় যার অর্থ হুলুদ ফুলের দেশ।

বিশেষ করে রাখাইনদের কাছে রামু পরিচিত ছিল প্যানওয়া নামে। এমনকি ইংরেজ আমলেও বর্মি রাজার দাপ্তরিক নথিপত্রে Panwa বা প্যানওয়া নামটি ব্যবহৃত হয়েছে। এই নামটিরও ইতিহাস আছে বৈকি।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র গভর্নরের পক্ষ থেকে ১৭৯৮ সালে এই এলাকায় জরিপ করতে আসেন ফ্রান্সিস বুকানন। জরিপ শেষে তিনি বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন যার নাম “An account of the frontier between the southern part of Bengal and the  kingdom of Ava”। এটা প্রকাশিত হয় ১৮২৫ সালে।

উক্ত প্রবন্ধটি এই অঞ্চলের জন্য একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল। ফ্রান্সিস বুকানন বাঁকখালী নদীর উপরের অংশে, অর্থাৎ গর্জনিয়া ঈদগড় এলাকায় জুমিয়া সম্প্রদায়ের সাথে কথা বলে জানতে পারেন যে জুমিয়ারা বাঁকখালী নদীকে ডাকে প্যাঙওয়া (Pangwa) নামে। হতে পারে ঐ প্যাঙওয়া থেকেই প্যানওয়া নামটি এসেছে।

বাকি থাকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজর্ষি উপন্যাস এবং বিসর্জন নাটকের প্রসঙ্গ। রাজর্ষি উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস ( Historical Novel)। ইতিহাসকে নির্ভর করে এই উপন্যাসটি লেখা হলেও এটি কোন পরিপূর্ণ ইতিহাস নয়। পরবর্তীতে এই উপন্যাস এর উপর ভিত্তি করে বিসর্জন নাটকটি লেখা হয়।

রবীন্দ্রনাথ নিজেই রাজর্ষি উপন্যাসের সূচনায় বলেছেন “এ আমার স্বপ্নলব্ধ উপন্যাস ”। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামুতে বসে রাজর্ষি উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন, এটা শুধু কল্পনাতেই মানায় ইতিহাসের পাতায় নয়। কবিগুরু রামুতে এসেছিলেন, এমনটা মনে করার কোন কারণ দেখি না। তবে রাজর্ষি উপন্যাসে রামু’র রামকোট দুর্গে ত্রিপুরারাজ আরাকান রাজার রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি সত্য।

(২য় অংশ রামকোট প্রসঙ্গ নিয়ে পড়তে চোখ রাখুন জ্ঞানান্বেষণ পাঠাগার ওয়েবজিনে)

তথ্যসূত্র:

  •  Shuniti Bhushan Qanungo, A History of Chittagong,1988.
  • Journal of the Asiatic Society of Bengal. Vol.LXVII,CALCUTTA 1898.
  • lama Tarnath Account of Bengal, Louis de La Vallée Poussin Memorial Volume 1940,calcutta.
  • Report on the Antiquities of Arakan, Emanuel Forchhammer, 1892.
  • World Buddhism, vol.23.
  • Sharat Chandra Das Rai Bahadur, Antiquity of Chittagong, Journal of the Asiatic Society of Bengal, vol.LXVII, Calcutta, 1898.
  • Indian culture, vol. 7,1940.
  • Franchise Buchanan, the Edinburgh journal of science, vol.।।। M.DCCC.XXV, London.
  • চৌধূরী শীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি, চট্টগ্রামের ইতিহাস।
  • First englishman in india by J.Courteny Locke,1930, London.
  • Ralph Fitch by J Horton Ryley, London, 1899.
  • Samuel Purchas, Pilgrimage or relations of the world and the religions,Vol.5 1626, london.
  • বাংলাপিডিয়া।

লেখক: শিরুপন বড়ুয়া, আইনজীবী ও ইতিহাস বিশ্লেষক।

shirubarua@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *