আরাকান সড়ক ও রামু’র সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

শিরুপন বড়ুয়া

চট্রগ্রাম থেকে তৎকালীন বার্মার আরাকানে যাতায়াতের জন্য যে রাস্তা আছে সেটা আরাকান সড়ক নামেই পরিচিত। অনেকের কাছে আবার শাহ সুজা সড়ক নামেও পরিচিত। অনেকে আবার রামু-মরিচ্যা-উখিয়া-টেকনাফ সড়ককে শাহ সুজা সড়ক বলে মনে করে ভুল করেন।

এটি আসলে শাহ সুজা সড়ক নয়,বরং ‘নতুন আরাকান সড়ক’ নামেই ইতিহাসে পরিচিত। এটি যদি নতুন হয়,তবে পুরাতন আরাকান সড়ক কোনটি? তাছাড়া মোগল শাহজাদা শাহ সুজা কোন আরাকান সড়ক ব্যবহার করেছিলেন আরাকানে আশ্রয় নেওয়ার সময়?

বর্তমানে রামু উপজেলা থেকে দক্ষিণ দিকে ‘রামু-মরিচ্যা সড়ক’ নামের যে রাস্তাটি উখিয়া এবং টেকনাফমুখী  সেটিই ‘নতুন আরাকান সড়ক’। শাহ সুজা আরাকানে পালিয়ে যাওয়ার সময় এই রাস্তাটি ব্যবহার করেননি।

বরং ব্যবহার করেছিলেন প্রাচীন আরাকান সড়ক, যেটি ঈদগড় – গর্জনিয়া পাগলির বিল হয়ে আরাকানের মংডু পর্যন্ত চলে গিয়েছে। এই প্রাচীন রাস্তাটিই হলো পুরাতন আরাকান সড়ক। মূলত এই রাস্তাটি ব্যবহার করেই আরাকানীজরা বাংলার সাথে যোগাযোগ রাখত।

বাংলাদেশ তথ্য বাতায়নের ওয়েবসাইটে রামু উপজেলার পরিচিতিমূলক বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া,এবং ঈদগড় ইউনিয়ন এর উপর এই সড়ক শাহ সুজার লোকজন নির্মাণ করেছিল।

একই ওয়েবসাইটে আরো বলা হয়েছে যে, ডা: নীহার রঞ্জন রায় ও অন্যান্য পন্ডিতদের মতে এটি নবম থেকে একাদশ শতকের কোন এক সময় নির্মিত। যদি তাই হয় তবে শাহ সুজা রামুতে আসার অনেক আগেই পুরাতন আরাকান সড়কটির অস্তিত্ব ছিল।

শুধু তাই নয়, ঐ রাস্তাটি ব্যবহার করেই আরাকানী শাসকরা রামুসহ চট্রগ্রামে তাদের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতো। শাহ সুজা যে রাস্তা ব্যবহার করে আরাকানে আশ্রয় নেন সেই রাস্তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পর্তুগীজ মিশনারী পর্যটক সাবিস্টিয়ান ম্যানরিকের লেখায় পাওয়া যায়।

এই ইউরোপীয়ান পর্যটক ১৬৩০ সালের ৫ই জুলাই রামুতে আসেন। তখন রামুতে একজন আরাকানীজ গভর্নর ছিল। ম্যানরিকের বর্ণনামতে রামুর গভর্নর ৫৩ জন বাঙ্গালী এবং ৩০ জন সৈন্যসহ তাঁকে আরাকানে যাওয়ার সকল ব্যবস্থা করে দেন।

কেননা রামু থেকে আরাকান যাওয়ার রাস্তাটি ছিল খুবই দুর্গম এবং বন্যপ্রাণীতে ভরা। ম্যানরিকের মতে তখন রামুর গভীর জঙ্গলে নাকি বাঘও ছিল। ম্যানরিক আরাকান যাওয়ার আরো ৩০ বছর পর ঐ একই রাস্তা ধরে মোগল শাহজাদা শাহ সুজা আরাকানে পৌঁছান।

ব্রিটিশ আমলের কিছু নথি এবং সার্ভে সংক্রান্ত বইও একই কথা বলছে। ব্রিটিশ সার্ভেয়ার এবং ঐতিহাসিকদের মতে রামু’র গর্জনিয়া ঈদগড় হয়ে ছোট একটা রাস্তা অনেক আগে থেকেই ছিল যেটা দিয়ে আরাকান যাওয়া যেত। ব্রিটিশরা তাদের নথিতে ঐ রাস্তাটিকে মূলত একটি বার্তা বাহকদের ব্যবহারযোগ্য গ্রাম্য পথ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

এই ছোট রাস্তা দিয়েই শাহ সুজা আরাকানে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। শাহ সুজা কেন আরাকান পালিয়েছিলেন যদিও এই লেখার বিষয়বস্তু সেটা নয়, তারপরও ইতিহাসের খাতিরে একটু আলোচনা করাটা কর্তব্য বলে মনে করছি। তারপর আমরা ফিরে আসব মূল আলোচনায়।

মোগল শাহজাদা শাহ সুজার মৃত্যুর সাথে রামু জনপদটি মোগল পতাকাতলে চলে যাওয়ার একটা যোগসূত্র আছে। রামু নামের আমাদের এই ছোট্ট জনপদটি কিন্তু মোগলদের অধিকারে আসে ১৬৬৬ সালের পর। তার আগে রামু আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিল।

ইতিহাসে দেখা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন রাজবংশে প্রতিনিয়ত ক্ষমতার লড়াই হয়েছে। লড়াই হয়েছে সিংহাসনের জন্য। এই লড়াইয়ে পিতার মুখোমুখি হয়েছে পুত্র, ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে ভাই। ভারতবর্ষের মোগল সাম্রাজ্য এর ব্যতিক্রম ছিল না।

এর একটা কারণ ছিল, বাদশাহ যদি একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেন,তখন রাণীদের মধ্যে একটা প্রতিযোগীতা হয় তাঁদের নিজ নিজ সন্তানদের ক্ষমতার সনদে বসানোর জন্য। আর এই প্রতিযোগীতায় এক ভাইয়ের হাতে অন্য ভাই বেঘোরে প্রাণ হারাতো।

আর সে ভয় থেকেই মোগল সম্রাট শাহ জাহান হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তাঁর সব সন্তানের মা হবেন একজন, তিনি হলেন মুমতাজ মহল। যাঁর স্মরণে শাহ জাহান নির্মাণ করিয়েছিলেন তাজমহল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল কি?

না, বৃদ্ধ শাহ জাহান অসুস্থ হতে না হতেই তাঁর চার ছেলে সিংহাসনের জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। আর সেই যুদ্ধে পরাজিত শাহ জাহানের দ্বিতীয় পুত্র বাংলার সুবেদার শাহ সুজা প্রাণ বাঁচাতে চট্রগ্রাম এবং রামু হয়ে পালিয়ে গেলেন আরাকানে। যাওয়ার সময় রেখে গেলেন কিছু স্মৃতি।

যেমন রামু’র কাছাকাছি এসে এক স্থানে পড়লেন পবিত্র ঈদের নামাজ। জায়গাটির নাম হয়ে গেল ‘ঈদগাঁ’। একইভাবে যে রাস্তা দিয়ে তিনি আরাকান পালিয়েছিলেন, সে রাস্তাটির নাম হয়ে গেল শাহ সুজা সড়ক। কিন্তু বিষয়টা এমন না যে সুজা আরাকান যাওয়ার আগে চট্রগ্রাম হয়ে রামু থেকে আরাকানে যাওয়ার কোন রাস্তা ছিল না বা সুজার লোকজন রাস্তা তৈরি করতে করতেই এগিয়ে গিয়েছিল আরাকানের উদ্দেশ্যে।

রাস্তা একটা আগে থেকেই ছিল। সেটিই হচ্ছে পুরাতন আরাকান সড়ক যা রামু উপজেলার ঈদগড় এবং গর্জনিয়া ইউনিয়নে এখনো আছে। এই সড়কটি কিন্তু চট্রগ্রাম থেকেই শুরু হয়েছে।

কিন্তু ১৮২৪ সালের মে মাসে এই রামুতেই ঘটে যাওয়া এক ভয়ংকর যুদ্ধে বার্মিজদের হাতে ইংরেজরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। যা ইতিহাসে ‘ব্যাটল অব রামু‘ নামেই পরিচিত।

এই যুদ্ধটি আকারে ছোট হলেও এর ফলাফল ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসকদের বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। এমনকি কলকাতা পর্যন্ত কেঁপে উঠে বার্মিজদের ভয়ে। কিন্তু বার্মিজ সেনাপতি মহা বান্ডুলা চকরিয়া পর্যন্ত দখল করে যুদ্ধ থামিয়ে বার্মা ফিরে যান। ইংরেজরা যেন স্বস্তি ফিরে পেল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে তখন এর প্রতিশোধ স্বরূপ আরাকান দখলের পরিকল্পনা করা হলো। আর সেই লক্ষ্যেই সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনে একটি নতুন রাস্তা তৈরির পরিকল্পনা করে ব্রিটিশরা। সেই রাস্তাটিই হচ্ছে আজকের রামু-মরিচ্যা-উখিয়া-টেকনাফ সড়ক, যার নামকরণ করা হয় ‘New Arakan Road’। Google ম্যাপে এর নাম Ramu-Maricha Road।

সম্পূর্ণ সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হোয়াইট সর্বপ্রথম রামু থেকে আরাকানে যাওয়ার নতুন একটি রাস্তা তৈরির উদ্যেগ নেন। তিনি রামুর কিছু জংগল এবং পাহাড় কেটে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন,তবে তিনি সফল হননি।

কেননা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরে তখন বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। ঐ বিদ্রোহের পেছনে রামু যুদ্ধের সরাসরি প্রভাব ছিল। বার্মিজদের কাছে রামুতে পরাজিত হওয়ার পর ইংরেজরা আরাকান আক্রমণের যে পরিকল্পনা করে, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আসে ৪৭ বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর।

কিন্তু পুরো ভারতবর্ষে দাপট দেখানো ইংরেজরা যখন রামুতে বার্মিজদের হাতে বেঘোরে প্রাণ হারায়, তখন বার্মিজ সৈন্যদের মুখোমুখি হতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা রাজি হচ্ছিল না। এছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রামের দক্ষিণে রামু পর্যন্ত এলাকা দুর্গম ছিল।

ঔরঙ্গজেবের জীবনী আলমগীরনামাতেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের বিদ্রোহের কারণে ১৮২৪ সালে নতুন আরাকান সড়কের কাজ থেমে যায়।

এরপর ১৮৫৪-১৮৫৬ সাল নাগাদ রামু-মরিচ্যা সড়কটির নির্মাণ কাজ আবারো শুরু হয়। মাঝখানে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় এর কাজ আবারো বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৮৭৩ সালে রামু হতে মরিচ্যা হয়ে উখিয়া ঘাঁট পর্যন্ত আরাকান সড়কটির আধুনিকায়নের  কাজ পুরোদমে শুরু হয়। সড়কটিতে কিছু সেতু নির্মাণ করা হয়।

এর আগেই রামু হতে আরো একটি রাস্তা কক্সবাজার অবধি তৈরি করা হয়। যার দৈর্ঘ্য ছিল ১০ মাইল। আজকের রামু চৌমুহনীর গোল চত্বর হতে উপজেলা পরিষদের সামনে দিয়ে কক্সবাজারের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটিই হচ্ছে সেই রাস্তা। ঐ সময়ই বাংলাবাজার এলাকায় বাঁকখালি নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়।

আসলে ১৮২৪ সালের রামু যুদ্ধে পরাজয়ে ইংরেজরা এই এলাকাতে তাদের একটি শক্ত সামরিক ঘাঁটির অভাব ভালোভাবেই টের পায়। তাছাড়া প্রাচীন কাল থেকেই এই জনপদটি বিভিন্ন রাজার আমলে, এবং বিশেষ করে আরাকান রাজাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ছিল।

১৬৬০ সালে মোগল বাদশা ঔরঙ্গজেবের আমলে রামু আরাকান রাজার হাতছাড়া হয়। শাহ সুজাকে আরাকানে হত্যা করা হলে প্রতিশোধ নিতে মোগলরা চট্রগ্রাম সহ রামু থেকে আরাকানিদের বিতাড়িত করে।

আরাকানের মগ সৈন্যরা রামুর রামকোটে অবস্থিত তাদের দুর্গে আশ্রয় নিলেও মোগল সেনাপতি বুজর্গ উমেদ খান সেই দুর্গ দখল করে নেন। পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্রগ্রামের সাথে রামুরও দখল পায় আনুমানিক ১৭৬০ সালে।

রামু যুদ্ধের পর এই এলাকার সামরিক ঘাঁটির সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে একটি আধুনিক রাস্তার প্রয়োজনীয়তা থেকেই নতুন আরাকান সড়কের নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়ে। সেই সাথে পুরাতন আরাকান সড়ক অর্থাৎ শাহ সুজা সড়কটি ব্রিটিশরা পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।

হালের রামু সেনানিবাসও গড়ে উঠেছে ব্রিটিশদের তৈরি করা নতুন আরাকান সড়কের পাশে।  তাই রামুর ইতিহাসে আরাকান সড়কটি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই সড়কটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আধুনিক রামু, যার শুরুটা হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। পাশাপাশি এই সড়কের সাথে জড়িয়ে আছে ‘রামু যুদ্ধের’ ইতিহাস।

তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের নথিতে দেখা যায় এসব রাস্তা তৈরিতে ব্রিটিশরা আরাকানিজ শরণার্থীদেরই বেশি ব্যবহার করত। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ক্যালকাটা গেজেট হতে জানা যায় রামু হতে উখিয়া ঘাঁট পর্যন্ত নতুন আরাকান সড়ক এবং  রামু হতে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক দুটি প্রশস্তকরণের মাধ্যমে A ক্যাটাগরির সড়কে রুপান্তর করা হয়।

অর্থাৎ সড়ক দুটির প্রস্থ ১৬ ফিট করা হয়। রামু হতে মরিচ্যা পর্যন্ত সড়কটি কিছুদিন আগেও বেশ সংকীর্ণ ছিল।যারা কিছুদিন আগেও রামু হতে উখিয়া বা টেকনাফ যাতায়াত করেছেন তারা হয়তো ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন।

বর্তমান সরকারের আমলে আরাকান সড়কের এই অংশটি আবারো প্রশস্ত করা হচ্ছে। এতে আরাকান সড়ক আবারো প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। তাছাড়া রামুতে সেনানিবাস স্থাপনের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় জনপদ রামু তার হারানো ঐতিহাসিক ঐতিহ্য পুনঃরায় ফিরে পেয়েছে। ইতিহাসের পাতায় রামু বেঁচে থাকুক আরো শত শত বছর।

তথ্য সূত্র:

১। http://www.ramu.coxsbazar.gov.bd

২। L. S. S. O’Malley, Eastern Bengal District Gazetteers: Chittagong, 1908, Calcutta।

৩। Jacques Leider. The Chittagonians in Colonial Arakan:Seasonal and Settlement Migrants।

৪। East India Company and Arakanese Refugee in Chittagong।

৫। W.W Hunter. A Statistical Account of Bengal. London,1876।

৬। The Calcutta Gazette, 10 May, 1876।

৭। https://barrackpore.cantt.gov.in/about-us/

৮। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Barrackpore_mutiny_of_1824

৯। B.R Pearn, Arakan and the First Anglo-Burmese War 1824-25.

১০। U Ba Tha. Slave Raids in Bengal, The Guardian Rangoon. Voll. VII,October 1960.

ছবিঃ বাংলাদেশ তথ্য বাতায়ন এবং লেখক।

(বি:দ্র: ইটের রাস্তাটিই শাহ সুজা সড়ক, ইটগুলো কিন্তু বর্তমানের, অপর দুটি ছবি আরাকান সড়ক বা রামু মরিচ্যা সড়কের। বর্তমানে নতুনভাবে প্রশস্তকরণের কাজ চলছে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *