আন্তন চেখভের ‘ভানকা’ অবুঝ মনের সরল জিজ্ঞাসা ও হাহাকার

মনির ইউসুফ

আন্তন চেখভ এক অসাধারণ রুশ লেখক। রাশিয়ান ছোট গল্পের আমি আগ্রাসী পাঠক। যখন যেখানে যা পাই বাছবিচার ছাড়াই পড়ে ফেলি। আর চেখভের গল্প আমাকে যাদুর মত টানে। চেখভের গল্প সমগ্র কেনা হয়েছে বহু আগে।

এতদিনে প্রায় গল্পে আমি মন বুলিয়েছি, অনেকগুলো পড়া শেষ। প্রতিটা গল্পই নতুন, দুঃখী, গরীব, এতীম, শ্রমিক, অসহায় মানুষের কথা ও তাদের মুক্তির কামনা, দরদ দিয়ে সাঁটা। চেখভের গল্প একপাঠে হয় না, বহুপাঠ দরকার হয়। গল্পের ভাষা বুননের সৌন্দর্য এক রকম, আবার মানবীয় দুঃখগুলোর মনোসমীক্ষণ অন্যরকম। ব্যক্তি জীবনের রুশীয় চিকিৎসক মানুষটি রুশ জাতিরই হৃদয়ের চিকিৎসক হয়ে ওঠেন।

রাশিয়া যত বড় তাদের সাহিত্যিকদের মনও তার চেয়ে বড়, মাটি যেমন উর্বর তেমনি মনও উৎকর্ষের মানবিক সৌন্দর্যে সরল। রেনেসাঁ, এনলাইটেটমেন্ট এবং পরবর্তীসময়ে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা মাথায় রেখে আমি এ কথা বলেছি।

চেখভ রাশিয়া জাতির মন তৈরির ভাষ্যকারদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক। পৃথিবীর প্রতি জন্ম নেওয়া মানুষের যে দায়বোধ, জাতির মাটি সন্তানদের মর্যদা-সম্মানের সহিত দেখানোর যে মনোচোখ তিনিই খোলে দিয়েছেন তার মূর্ত বিমূর্ত দরোজা-জানালা।

পৃথিবীর লেখকদের মধ্যে তা অনন্য। যারা রুশসাহিত্য পড়েন নাই, তাদের মনোগঠন একরকম, আর যারা রুশসাহিত্য পড়েছেন তাদের মনোবোধ অন্যরকম। আমি মনে করি প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রুশ সাহিত্য পড়ানো দরকার। শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্যে মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকার করতে রুশ সাহিত্য পৃথিবীতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

আন্তন চেখভের ‘ভানকা’ একজন এতিম রুশীয় শিশু। যার শ্রমিক বা চাকর হওয়ার কথা ছিল না, কিন্ত তার মা বাবার মৃত্যুতে তাকে জীবনের এই চরম সত্যের মুখোমুখি হতে হয়। এক প্রতিষ্ঠিত মুচির দোকানে শিশু ভানকা ঝুকভকে শিক্ষানবিশীর কাজ নিতে হয়।

কাজ করতে গিয়েই শিশুটি মুখোমুখি হন, রুশীয় অভিজাত্যবোধের নোংরামির। পৃথিবীর সব ধনীওয়ালারা অধঃস্তন শিশু শ্রমিকদের সঙ্গে যে আচারণ করে, রাশিয়াতেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। শিশু ভানকাকে নির্যাতনের মধ্যদিয়ে আমরা তা বুঝে ফেলি।

এতটুকু শিশুকে সামান্য ভুলের জন্য গৃহকর্তা ঘোড়ার রেকাব দিয়ে পেটায়, চুল ধরে টেনে হিচড়ে মেরে রুশীয় হীনমন্যতার সবটুকু ঢেলে দেন। আর গৃহকর্তী সামান্য ভুলের জন্য এই ছোট্ট শিশুর মুখের মধ্যে ঘষে দেন মাছের মাথা। বেচারা ভানকা ঝুকভ, তার সে কষ্ট বুকে নিয়ে শিক্ষানবিশী চালিয়ে যায়। আর তার মনে জাগে এই মানুষদের প্রতি অবুঝ জিজ্ঞাসা, আর উত্তর না পেয়ে তা হাহাকারে রূপ নেয়।

শিশু ভানকা ঝুকভের মধ্যদিয়ে চেখভ রাশিয়ার সামন্তীয় সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাঠকের সামনে উন্মোচন করেন। কতটা নোংরা, ইতর, ছোটোলোক এই রাশিয়ান বর্বর সমাজপতিরা। সে জুতা কারখানার মালিক হোক বা ভূসম্পত্তির জমিদার হোক।

তাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য একই। চেখভ ভানকা ঝুকভের মধ্য দিয়ে বিকাশশীল রাশিয়ার পুঁজিবাদী মনকে উন্মোচন করেন, আর ভানকার পিতামহীর মধ্যদিয়ে রাশিয়ার সামন্তীয় মনকে নগ্ন করে দেন।

চেকভের এই হচ্ছে বৈশিষ্ট্য যে একটি গল্পের মধ্যে বহু বিষয়ের ইঙ্গিত। মানুষের নোংরামি ইতরামিকে খুব কাছ থেকে তোলে ধরতে পারা।

চেকভের গল্প থেকে মানবজাতি শিক্ষা নিতে পারে অনেক। মানব চরিত্র সংশোধনে, তার মনোচিকিৎসায়, চেকভের গল্প হৃদয়ের প্রলেপের কাজ করে। এখান থেকে মানুষ শিখতে পারে জীবন-বীক্ষা। উচুঁ শ্রেণির মানুষের নোংরামি, ইতরামী, ছোটলোকীপনা, রিরংসা, হিংসা, অহংকারকে নিমর্মোহভাবে তোলে ধরেন চেকভ। তাই পৃথিবীতে চেকভের গল্প অনন্য।

আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাষ্টারের ‘রতন’ এতিম বালিকাটি দেখি, দেখি তার হৃদয়ের আর্তি, ভানকা গল্পের ‘ভানকা ঝুকভে’র হৃদয়ের আর্তি মিল খোঁজে পাই না। রবীন্দ্রনাথ হৃদয়ের ভাবের রেণুকে নিয়ে কারবার করেছেন। সেখানে শ্রেনিবৈষম্য, সামাজিক বাস্তবতা নেই।

সেখানে মায়ার বাঁধনে বাধা পড়া ও ভেঙে পড়ার কষ্ট। মেয়েটি শ্রেণিকষ্টের বিষয়টি সেখানে আসে নাই। অতটুকু মেয়ের পোস্টমাস্টারের সেবা করার শারীরিক কষ্টের বিষয় উল্লেখ নেই, সেবা করার দায়িত্ব উল্লেখ আছে। যেন এতিম মেয়েটির জন্ম হয়েছে পোস্টমাস্টারদের মত উঁচুতলার মানুষকে সেবা করার জন্য।

কিন্তু চেখভ ভানকা গল্পে কি বাস্তবতায় না দেখিয়েছেন সমাজের উঁচুতলার মানুষের চরিত্র, আর তাদের অযথা আক্রোশ ছোট্ট শিশুর উপর।

এইজন্য রাশিয়ায় মানুষের মন তৈরি হয়েছিল মানবিক বাস্তবতায়। একটি জাতিই শিখেছিল মানবিকতার শিক্ষা। আর আমাদের মন তৈরি হয়েছিল মায়ায়। দান-দয়ায়। পোস্টমাস্টারের বালিকাটিকে শেষ দয়া ও দানের মানসিকতা থেকে তা আমরা বুঝতে পারি।

রবীন্দ্রনাথের এই উদারনৈতিকতা আমাদের সাহিত্যকে সর্বনাশ করেছে, মানুষের দায়িত্ব নিতে না শিখা এই জীবন, নিজের করা অন্যায়কে প্রবোধ দিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া। ক্ষণিক দয়ার উদয়তে আরও পাষাণ হয়ে পড়া এবং নিয়তির কাছে সমর্পন।

কিন্তু রাশিয়ান সাহিত্য এসব উদারনৈতিকতা ও নিয়তিকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়েছে। মনের দ্বিধাকে বাস্তবতার পাথরে ঘষেমেঝে এক নতুন পৃথিবী উপহার দিয়েছে। আর ভারতীয় সাহিত্য সে ভাবের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে এখনও। তাই, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে চেখভ মানবজাতির কাছে কত আপন। আর ভানকা গল্পটিসহ এ রকম অসংখ্য গল্পই তার প্রমাণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *