রাজিক হাসান
বুদ্ধ তখন গহীন জঙ্গলে গভীর ধ্যানে আচ্ছন্ন। সুন্দর পোশাক পরিহিত কিছু যুবক পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। যুবকদের প্রধান বুদ্ধকে প্রণাম করে বলল, “হে সাধু, আপনি কি কোন অল্প বয়সী স্ত্রী লোককে এই পথে দৌঁড়ে যেতে দেখেছেন?”
বুদ্ধ জিজ্ঞেস করলেন, “কেন তুমি তাঁকে খুঁজছো?”
যুবকটি জানালো তারা বারানসি থেকে এসেছে। গতকালই এই বনে এসেছে। সঙ্গে তাদের নানা বাদ্যযন্ত্রও এক অল্প বয়সী স্ত্রীলোক ছিল। গান-বাজনা আর নাচের পর খাবার খেয়ে তারা জঙ্গলের মাটিতেই ঘুমিয়ে পরে। ঘুম থেকে উঠে তারা দেখে স্ত্রীলোকটি তাদের মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে পালিয়েছে। তখন থেকেই তারা ওই স্ত্রী লোকটিকে ধাওয়া করছে।
বুদ্ধ শান্তভাবে যুবকদের সবাইকে দেখলেন আর বললেন, বলতো বন্ধুরা, এখন স্ত্রীলোকটিকে খুঁজে বের করা নাকি তোমাদের নিজেকেই খুঁজে বের করা কোনটি বেশি জরুরী হবে। যুবকেরা চমকে গেল। একজন বলে উঠলো, হে সম্মানিত সাধু, মনে হয় প্রথমে আমাদের নিজেদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। বুদ্ধ বলে উঠলেন, জীবনকে শুধুমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় বর্তমান সময়ে। কিন্তু আমাদের মন খুব কম সময়ই বসবাস করে এই বর্তমানে। এর পরিবর্তে সে ধাওয়া করে অতীতে বা সুদূর কোন ভবিষ্যতে। আমরা মনে করি আমরা নিজের সাথেই আছি, কিন্তু আসলে খুব কম সময়েই আমাদের যোগাযোগ থাকে নিজের সাথে। তার চেয়ে বরং আমাদের মন অধিক ব্যস্ত থাকে গতকালের স্মৃতি অথবা আগামীকালের স্বপ্নকে নিয়ে। দেখো ওই কচি পাতাগুলোকে। সূর্যের রশ্নিতে কেমন ঝলমল করছে। কখনও কি দেখেছো নির্মল ওস্ফুরিত হৃদয়ে পাতাগুলির সবুজ রং? এই সবুজ ছায়া হচ্ছে জীবনের এক বিস্ময়।
বুদ্ধের কথায় প্রত্যেকের চোখ সবুজ পাতাগুলিতে স্থির হলো। তারা দেখতে পেল, সবুজ পাতাগুলো কেমন ঝিঁরিঝিরি বাতাসে দুলছে। একটুপর বুদ্ধ সবাইকে তার ডান পাশে বসতে বললেন। “আমি দেখছি তোমার সাথে একটি বাঁশি আছে। অনুগ্রহ করে কি আমাদের জন্য বাজাবে?” বুদ্ধ অনুরোধ করলেন। যুবকটি লজ্জিত হলো, তারপর সেতার বাঁশিটি ঠোঁটে নিয়ে বাঁজাতে শুর করল। অন্য সবাই অনন্য চিত্তে শুনতে লাগল। বাঁশিতে ছিল এক হৃদয় ভাঙা প্রেমিকের কান্নার সুর। করুণ সুরে সে যেন কাঁদছে তো কাঁদছেই। যখন যুবকটির বাঁশি থেমে গেল তখন যেন বিষণœতার এক পর্দা উঠল শেষ বিকেলের অরণ্যতে। চারিদিকে সবাই যেন চুপ হয়ে আছে, যেন থমকে গেছে সবকিছু। হঠাৎ যুবকটি তার সেই বাঁশি বুদ্ধের পায়ের কাছে রেখে বলে উঠল, হে সন্ন্যাসী, অনুগ্রহ করে এবার আপনি সুর বাজান।
বুদ্ধ মৃদু হাসল। কিছু যুবকেরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল যেন সেই যুবকটি বোকার মতো কিছু বলেছে। আসলেই তো কেই বা শুনেছে সন্ন্যাসী বাঁশি বাজাতে পারে। কিন্তু বুদ্ধ সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাঁশিটি নিজের হাতে নিল। কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাঁশিটি ঠোঁটের কাছে উঠালো। সমগ্র বনভূমি যেন এক অনাবিল শান্তির চাদরে ঢেকে গেল। যুবকেরা বুদ্ধের চারিদিকে গোল হয়ে বসল। তারা প্রত্যেকেই অরণ্যের বিস্ময়ে, বুদ্ধ, আর বাঁশিতে আর তাদের বন্ধুত্বের বন্ধনে হারিয়ে গেল।
এরপর যুবকটি বুদ্ধকে বলল, আমি জীবনে এতো সুমধুর সুর কাউকে বাজাতে শুনিনি। আপনি আমাকে আপনার শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন? আমি যেন শিখতে পারি।
বুদ্ধ মৃদু হেসে উত্তর দিল, আমি যখন বালক ছিলাম তখন আমি বাঁশি বাজাতে শিখি। কিন্তু আমি গত সাত বছরে একবারও কোন বাঁশি বাজাইনি। যদিও আমার আজকের তোলা সুর আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে।
যুবকটি জিজ্ঞেস করে, আপনি কী করে সাত বছর কোন চর্চা না করেই বাঁশি বাজানো উন্নত করেছেন?”
উত্তরে বুদ্ধ বললেন, বাঁশি বাজানো সম্পূর্ণভাবে শুধু চর্চার উপর নির্ভর করে না। আমি এখন আগের চেয়েও ভালো বাজাতে পারি কারণ আমি আমার প্রকৃত সত্ত্বাকে খুঁজে পেয়েছি। তুমি শিল্প বা সঙ্গীতের সর্বোচ্চ চূড়ায় তখনই পৌঁছাতে পারবে যখন তুমি নিজের হৃদয়ের অনতিক্রম্য সৌন্দর্যকে খুঁজে পাবে। তুমি যদি সত্যিই খুব ভাল বাঁশি বাজাতে চাও, আগে তোমার সত্যিকারের তোমাকে খুঁজে নাও।