হিরাম কক্সের বাংলোয় যেভাবে যাবেন

শিপ্ত বড়ুয়া

কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর বুকে এক অনন্য নাম। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচ থেকে প্রতিদিন লাখো পর্যটক ঘুরতে আসেন কক্সবাজারে। কক্সবাজার ঘুরতে এসে ঐতিহাসিক সব জায়গা সম্পর্কে কি জানতে ও দেখতে পারেন পর্যটকরা। এমনি একটি ঐতিহাসিক মূল্যসমৃদ্ধ জায়গা রয়েছে রামুতে। কক্সবাজার জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে রামু উপজেলা।

রামু উপজেলার অফিসের চর গ্রামে অবস্থিত শত বছরের হিরাম কক্সের বাংলো। রামু চৌমুহনী স্টেশনে নেমে যে কাউকে রামু অফিসের চর ডাক বাংলো’র নাম বললেই আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দিবে। চৌমুহনী স্টেশন থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে রাস্তার ডান পাশে দেখতে পাবেন নিরব নিস্তব্ধ একটি ব্রিট্রিশ নকশার বাড়ি।

প্রায় এক একর জায়গাজুড়ে বাড়িটাই তৎকালীন বৃটিশ কূটনীতিক হিরাম কক্সের বাংলো। বাংলোর চারপাশে শত শত মেহগনি গাছ আর কাঠাল গাছ দেখতে পাবেন। মূল ফটক দিয়ে ডুকতেই আপনি দেখা পাবেন ষাটোর্ধ মো: বদিউজ্জামানের। গত ত্রিশ বছরের অধিক সময় ধরে তিনি এখানে ডাক বাংলোর দেখাশুনা করছেন। মো: বদিউজ্জামানের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, বিশেষ করে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ মাঝেমধ্যে এখানে থাকতে আসেন।

তাছাড়া তিনি আরেকটি সুযোগের কথাও জানান, বে-সরকারি কোন পর্যটকও চাইলে এখানে থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে যথাযথ পরিচয় এবং প্রতি রাতের জন্য ৪০০ টাকা ভাড়া গুণতে হবে। ২৩০ বছরেরও অধিক পুরানো হিরাম কক্সের এই বাংলোয় রাত যাপন করতে চাইলে কক্সবাজার জেলা পরিষদ কিংবা রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা’র সাথে যোগাযোগ করা যাবে।

বাংলোর ভিতরে প্রবেশ করা মাত্রই দেখা যাবে বিশাল বড় একটি বারান্দা। কথিত আছে হিরাম কক্স এখানে বসেই অবসর সময় কাটাতেন। বারান্দার ডান পাশের রুমে দুইটি কাটের খানদানি খাট বসানো আছে আর একটি সংযুক্ত টয়লেট। বারান্দার বাম পাশের রুমটি এখানকার বড় রুম। এই রুমে আছে একটি খাট আর সোফা। বদিউজ্জাম জানান, সম্প্রতি জেলা পরিষদ থেকে এসব আসবাবপত্র পুনঃসংযোজন করা হয়েছে।

এই ডাক বাংলোর দেখাশুনার দায়িত্বে থাকা মো: বদিউজ্জামান আরো বলেন, বর্তমানে অবস্থিত এই ভবনটি কক্সবাজার জেলা পরিষদ কর্তৃক পুনঃনির্মাণ করা। হিরাম কক্সের সময়ের ভবনটি ছিল পুরো কাঠের তৈরি। জেলা পরিষদের মাধ্যমে নিয়মিত এই ভবনটি শক্ত-পোক্ত করা হচ্ছে। যদিও এই ডাক-বাংলোর আসল কাঠের ভবনটি বর্তমান ভবনের মতোই দেখতে ছিল।

বর্তমান পর্যটন নগরী কক্সবাজার যার নামে নামকরণ করা হয়েছে তিনি হলেন ১৮ শতকের একজন বৃটিশ কূটনীতিক যার নাম ছিল হিরাম কক্স। কক্সবাজারের আদি নাম পালংকী। পরে হিরাম কক্সের নামেই পালংকীর নামকরণ করা হয় কক্সবাজার।

রামুর তরুণ ইতিহাস গবেষক এডভোকেট শিরুপন বড়ুয়া’র সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, ১৭৮৪ সালের আগে ভারতবর্ষ এবং মিয়ানমারের মাঝখানে ছোট একটি স্বাধীন রাজ্য ছিলো,যার নাম আরাকান।  একই সময়ে বর্মী রাজা বোধপায়া আরাকান দখলের জন্য তার সৈন্যদের যুদ্ধের আদেশ দেন এবং সেই অভিযানের দায়িত্ব প্রদান করেন তাঁরই পুত্র যুবরাজ থাডো মিনসোকে।

এরপর বর্মী যুবরাজ থাডো মিনসো সহজেই পরাজিত করেন আরাকান অধিপতিকে। আরাকান দখল করার পর বর্মীরা ঠিকই রাখাইনদের অত্যাচার করতে লাগলো । তখন হাজার হাজার রাখাইন নাফ নদী পার হয়ে তৎকালীন বিট্রিশ শাসনাধীন এলাকা বর্তমানের টেকনাফ, উখিয়া,রামু,কক্সবাজার,হারবাং ইত্যাদি এলাকায় উদ্বাস্তু হিসেবে প্রবেশ করতে লাগলো।

ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত জার্নাল সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজ (ভলিয়ম-১২) এর জি.পি রামচন্দ্রের লেখা (Captain Hiram Cox’s Mission to Burma, 1796-1798: A Case of Irrational Behaviour in Diplomacy) থেকেও হিরাম কক্স সম্পর্কে মোটামুটি কিছু তথ্য পাওয়া যায়। রাখাইন উদ্বাস্তুদের পুনঃর্বাসন করতেই তৎকালীন ব্রিটিশ কূটনীতিক হিরাম কক্সকে পালংকীতে পাঠানো হয়েছিল।

হিরাম কক্স পালংকিতে আসার পর তাকে পালংকীর মহাপরিচালক নিযুক্ত করা হয়। ক্যাপ্টেন কক্স মহাপরিচালক নিযুক্ত হওয়ার পর নানান সমস্যা সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান এবং শরণার্থীদের পুণঃর্বাসনে বহুবার চেষ্টা করেন। কিন্তু এরমধ্যেই ১৭৯৯ সালে তিনি মারা যান। তৎকালীন শরনার্থী সমস্যাসহ নানান সমস্যা সমাধানের অবদান মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছিল।

দীর্ঘদিন পালংকীতে মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যখন মারা গেলেন স্থানীয়রা পালংকীর মূল বাজারকে কক্স সাহেবের বাজার বলে পরিচিতি দিতে থাকেন। যা বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে কক্সবাজার হিসেবে পরিচিত হয়েছে।

অফিসের চর গ্রামের বাসিন্দা ও রামু সরকারি কলেজের প্রভাষক মো: মুজিবুল হকের বাড়ি এই ডাক বাংলোর সামনা-সামনি, তিনি জানান, এই ডাক বাংলো বহু পুরানো এবং ইতিহাসসমৃদ্ধ । এখানে তেমন একটা কেউ থাকতে আসতে দেখা যায় না। আমি মনে করি এই ডাক বাংলোর ঐতিহাসিক মূল্য না জানা এবং প্রচারণার সঠিক অভাবের কারণে এখানে পর্যাপ্ত সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও পর্যটক আসছেন না।

তাছাড়া ডাক বাংলোর এলাকাজুড়ে কোথাও কোন পরিচিতি সাইনবোর্ড নেই। অন্তত একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করে এর ঐতিহাসিক মূল্য তুলে ধরা হলে পর্যটক ও সরকারি কর্মকর্তারা আরো বেশি অনুপ্রাণিত হবে।  আশা করি জেলা পরিষদ থেকে এই সামান্য কিছু উদ্যেগ শীগ্রই গ্রহণ করা হবে।

কক্সবাজার জেলা সদর থেকে ২৭ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থান হওয়ার পর্যটক আকর্ষণ কম বলে মনে করছেন স্থানীয় অনেকেই। তবে সরকারি সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রচারণা বাড়লে ঐতিহাসিক মূল্যবান এই ডাক বাংলো মানুষের মাঝে আরো বেশি সাড়া ফেলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *