শিপ্ত বড়ুয়া
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বর্তমান রামু উপজেলার পূর্ব রাজারকুল গ্রামে বিমানঘাটি কিংবা রামু রামকোটের পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা টাকশাল আর আরাকানি সময়ে এই রামু কতটা দায়িত্বপূর্ণ এলাকা ছিলো সেসব দুষ্প্রাপ্য ইতিহাস স্মৃতিরোমন্থন করার সুযোগ পাওয়া গেলো। যেখানে এখন আমি বসে আছি ঠিক এই জায়গায় শ’দুয়েক বছর আগে কারা ছিলো তা জানতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি।
তরুণ ইতিহাস গবেষক শিরু দার লেখা জাগতিক প্রকাশন থেকে হার্ডকভারে প্রকাশ হওয়া ১৬৭ পৃষ্টার বই “রামু: ইতিহাস-প্রেক্ষাপট-জনশ্রুতি” থেকে জানা যাবে রামুকে ঘিরে জানা-অজানা জনশ্রুতি ও ইতিহাসের রেফারেন্সসহ সঠিক ব্যাখ্যা। বইটির মুদ্রিত মূল্য ৪০০/= টাকা। রকমারিতে ডিসকাউন্ট মূল্যে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।
বইটি মূলত লেখকের বিভিন্ন সময় পত্রিকায় ও ডিজিটাল ম্যাগাজিনে লেখা প্রবন্ধের সংকলন। আমার সৌভাগ্য যে, জ্ঞানান্বেষণ এর ডিজিটাল প্লাটফর্মে এই বইয়ের অধিকাংশ অধ্যায় প্রবন্ধ আকারে ছাপানোর সময় যত্নসহকারে পড়ার সুযোগ হয়েছিলো। যখন রামুকে ঘিরে অনেকগুলো প্রবন্ধ পত্রিকা এবং ডিজিটাল প্লাটফর্মে প্রকাশ পেলো অধিকাংশ পাঠকের দাবী ছিলো গুরুত্বপূর্ণ এসব ইতিহাস বইবন্দি করার।
নয়টি অধ্যায়ে মোট এগারোটি প্রবন্ধে রামু ঠিক কতটা প্রাচীণ? টলেমির মানচিত্রে রামু ও রামুর বিকৃত হওয়া রামকোটের সঠিক ইতিহাস পাওয়া গেছে বইটিতে। ধর্মীয় বেড়াজালে অতিরঞ্জিত ইতিহাসে ঢাকা পড়েছে রামকোটের আসল ইতিহাস। বর্তমান রামু উপজেলার রামকোট এর আশেপাশের পাহাড়ে আরাকানী সময় এবং তারও আগের টাকশাল সম্পর্কে তথ্যপ্রমাণসহ সম্ভাবনার কথাও বলেছেন লেখক।
কানা রাজার সুড়ঙ্গ, লাউয়ে জাদি ও হিরাম কক্সের সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে “রামু: ইতিহাস-জনশ্রুতি-প্রেক্ষাপট” বইটি পড়তেই হবে। বইটির অষ্টম অধ্যায়ে “দ্যা ব্যাটল অব রামু” পড়তে গিয়ে ১৬৬৬খ্রিস্টাব্দে মুঘল-আরাকানি যুদ্ধের মাঠে ফিরে গিয়েছিলাম আমি। ক্ষণিকের কল্পনায় কখনো আরাকানি যোদ্ধা কিংবা রাজ্য ছেড়ে পালানো বর্মি রাজা মনে হয়েছে নিজেকে।
আগেই বলেছি বইটির অধিকাংশ প্রবন্ধ বই আকারে আসার আগেই আমি পড়েছি। তবে নবম অধ্যায়ের প্রবন্ধটি ছিলো নতুন। এই অধ্যায় আমাকে আরও বেশি রোমাঞ্চিত করেছে। কেননা আমি এখন যে গ্রামে থাকি সে গ্রামই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধ বিমানের রানওয়ে ছিলো। ভাবতেই শিহরিত হই। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় নেমে এই মাটির নিচেই সমাহিত হয়ে আছে অনেক যোদ্ধা, কতজন এলোগেলো। এই বিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা তাদের খুঁজে পেলাম রামু বইয়ের মাধ্যমে। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।
রামু সম্পর্কে শত শত বছর আগের তথ্যসূত্রসমৃদ্ধ ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে আমাদের ঋণগ্রস্ত করেছে লেখক শিরুপন বড়ুয়া। এর আগেও তিনি এতদ জনপদের গুরুত্বপূর্ণ দানবীর ‘খিজারী’ এর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে একটি বই প্রকাশ করেছেন। সেটিও পাঠকের কাছে সমান সমাদৃত হয়েছিলো।
বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার চেয়েও পুরানো রামু। রামুকে মননে ধারণ করেই লেখক তার পূর্ব ইতিহাসকে যত্নসহকারে হাতরে বেড়িয়েছেন। রামু বইটি কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে যুগের পর যুগ। প্রথমত রামকোটকে ঘিরে যে ইতিহাস বিকৃতি তা রোধ হবে এবং সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের রামুকে ঘিরে কাজের পরিধি বিস্তৃত হতে পারে। রামু যে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা প্রমাণে বইটি অসামান্য অবদান রাখবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পাঠপ্রতিক্রিয়া দিয়েছেন: শিপ্ত বড়ুয়া, সভাপতি, জ্ঞানান্বেষণ।
shipta52@gmail.com