অসীম বড়ুয়া
যদি প্রশ্ন করা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গল্প কোনটি? অনেকেই হাত তুলে হয়তো একবাক্যে আরব্য রজনীর সেই সহস্র এক রজনীর গল্পের কথা বলবে। আর বিদগ্ধ পড়ুয়াদের কেউ কেউ হয়তো রুশ লেখক লিও টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিসের কথাও বলে বসতে পারে।
কিন্তু হিসাব বলছে, কারও উত্তরই সঠিক নয়। আসলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গল্পের জন্মস্থান আরবেও নয়, রাশিয়াতেও নয়। বরং এর জন্ম আমাদের এই বাংলাদেশেই। আরও ভালো করে বললে, আমাদের গ্রাম-বাংলায় পানখেকো গল্পবুড়োদের মুখে মুখে জন্ম হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় গল্পটির।
অবশ্য প্রায় এরকম গল্প চালু আছে আফ্রিকার রূপকথায়। সেটিও নাকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় গল্প বলে দাবি আফ্রিকানদের। অর্থাৎ যে গল্পের কোন শেষ নেই। কিন্তু আসলেই কি তা? গল্পবুড়োদের এ ফাঁকিবাজি আর চাপাবাজির ভিড়ে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় শুনিয়েছেন আরেক গল্প।
সে গল্পেরও কোন শেষ নেই। চলমান, মানে টু বি কন্টিনিউ। সে গল্প হচ্ছে মানুষের গল্প, আমার আপনার গল্প। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত আদিম মানুষের উত্থানের গল্প। মানুষের উঠে দাঁড়ানোর গল্প। সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে ওঠার গল্প।
আরব্য রজনীর গল্পেরও একটা শেষ আছে। এক হাজার এক রাতের পর শেষ হয়েছিল সে গল্প। কিন্তু মানুষের গল্পের আসলে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যতদিন পৃথিবীতে মানুষ আছে, ততদিন চলতে থাকবে এ গল্প।
আদিম সময় থেকে মানুষ এবং তার পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব রাজনীতি আর বিজ্ঞান নিয়ে বিস্তর আর মোটা মোটা বই লেখা হয়েছে। রয়েছে অতি মূল্যবান রেফারেন্স বই কিংবা প্রমাণ সাইজের এনসাইক্লোপিডিয়া। কিন্তু এ বইটিতে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে শূন্য থেকে শুরু করে মানুষের উদ্ভব আর আজকের সমাজব্যবস্থা পর্যন্ত সব বৈশিষ্ট্যকে।
সহজ ভাষায় একেবারে গল্পের মতো করে শুধুই মানুষের কথা বইটির প্রতি পাতায় পাতায় তুলে ধরা হয়েছে। সহজ সাবলীল ভাষায় প্রকাশিত সমাজ বিকাশের লিখিত দলিল। বহু বছরের আগের কথা হলেও এগুলো আজ পর্যন্ত সত্য।
যে গল্পের শেষ নেই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫১ সালে। স্বাভাবিকভাবেই তখনকার দিনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির ছিল আকাশ-পাতাল তফাত। তাই একসময় ভীষণ জনপ্রিয় এ বইটিতে সময়োপযোগী তথ্য বা বিজ্ঞান যোগ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।
তাই দীর্ঘ ৪০ বছর পর, মানে ১৯৯১ সালে বইটি নতুন তথ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে ঢেলে সাজিয়েছিলেন লেখক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তবে সেটিও প্রায় ২৪ বছর আগের কথা।
সে সময়ের তুলনায় বিজ্ঞান এগিয়েছে আরও অনেকটা পথ। তাই এ সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে বইটির খুব সামান্য হলেও কিছু অসংগতি রয়েছে, যা পড়ে পাঠক হোঁচট খেতে পারে। যেমন, মৌলিক পদার্থের সংখ্যা এ বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে ৯২টি।
কারণ, নব্বইয়ের দশকের আগেও কটিই বা জানা ছিল মানুষের। এরকম আরও ছোট খাটো কিছু তথ্যগত ত্রুটি আছে বইটিতে। এসব ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত না হয়ে বিভিন্ন তথ্যকোষ ও জ্ঞানকোষের সঙ্গে মিলিয়ে পড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
নতুন যে কোন বইয়ের প্রতি মানুষের একটা অভ্যাস গড়ে উঠেছে। এটা আবার কেমন অভ্যাস? বলবো কিন্তু একটু পরে!
‘যে গল্পের শেষ নেই’ একে হচ্ছে নামটা ইন্টারেস্টিং বটেই! দ্বিতীয়ত এটা আবার কেমন গল্প? শেষ নেই এমন গল্পও পৃথিবীতে আছে নাকি? আছে! আছে! সেটা হচ্ছে তোমার গল্প, আমার গল্প, আমাদের সকলের গল্প। তার মানে মানুষের গল্প। আবার তার মানে গল্পই নয়, সত্যি কথা। সেটি হল দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যে গল্পের শেষ নেই’।
বলছি মানুষের অভ্যাসের কথাটা; ‘যে গল্পের শেষ নেই’ বইটার প্রথম দেখাতে আমার আবার তেমন কোন আগ্রহ জাগেনি। আগ্রহ জাগবেই বা কেন? ভাবলাম এটা আবার কেমন গল্প? সব গল্পের একটা শেষ-শুরু থাকে। শেষই নেই যার সেটি পড়ে লাভ কি?
কিন্তু একদিন বইয়ের খেলার ছলে বইটি হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে প্রথম পরিচ্ছদ পড়ে শেষ করে ফেললাম। তারপর অবাক হয়ে ভাবলাম পৃথিবীতে এমন গল্পও আছে যে গল্পের প্রথম পরিচ্ছদ পাঠককে আকর্ষণীয় করে তোলে, আগ্রহ বোধ জাগিয়ে তোলে আর সেটি যে গল্পের শেষ নেই বইটির প্রথম পরিচ্ছদ। এক কথায় বলতে গেলে এই বইয়ের লোভ, লালসা আমাকে এখনো পড়ার নেশায় ডুবায় প্রতিনিয়ত।
এই লোভ, লালসা নিয়ে বেশিদিন বসে থাকতে পারিনি। পরিশেষে বইটি শেষ করলাম! তারপর বুঝতে পারলাম এই গল্পের সত্যিই কোন শেষ নেই। মনে হলো এই গল্প – আমার গল্প, আমাদের সকলের গল্প। এরপর থেকেই এই বইয়ের প্রতি আমার প্রেম জাগে, দেবীপ্রসাদ চট্টেপাধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে। আবার মনে হতে লাগল এটা যেন কোন দেবীপ্রসাদ নন, স্বয়ং যেন দেবতা। আর আমরা তার পূজো করছি।
কিন্তু কে এই দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়? যার গল্পের কোন শেষ নেই, মানুষের রহস্যের কোন শেষ নেই, পৃথিবীর অজানা তথ্যের কোন শেষ নেই। ভারতের একজন প্রখ্যাত মার্কসবাদী দার্শনিক ও লেখক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি প্রাচীন ভারতের দর্শনের বস্তÍবাদের উদ্ঘাটন করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ হল লোকায়তের প্রাচীন দর্শনকে তিনি বিরুদ্ধপক্ষের বিকৃতি হতে রক্ষা করেন এবং তা সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছেন।
এছাড়াও তিনি প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাস ও বিজ্ঞানের পদ্ধতি সম্পর্কেও গবেষণা করেছেন বিশেষ করে প্রাচীন চিকিৎসক চরক ও সুশ্রুত সম্পর্কে।
প্রথমত বলতে গেলে খুবই তথ্যবহুল একটি বই ‘যে গল্পের শেষ নেই’। আমি মনে করি এটা শুধু শিশু-কিশোররা পড়ে মজা পাবে এমন না! সব বয়সের মানুষ, সব শ্রেণীর মানুষদের এই তথ্যবহুল বইটি অবশ্য পাঠ্য।
দ্বিতীয়ত, এই বইয়ের গল্পকার দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় অনেক সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের অনেক কঠিন কঠিন তথ্য এবং অনেক তত্ত্ব দিয়ে দার্শনিক কথাবার্তা দিয়ে অর্থাৎ একটা কিশোরকে কীভাবে বুঝানো যায় সেভাবে লিখেছেন। যেমন : ডাইনোসার থেকে শুরু করে পিরামিড পর্যন্ত কোন বিষয় এই বই থেকে এড়িয়ে যায়নি।
এই বইটিতে একটা রূপক ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন আমাদের সমাজকে যদি আমরা ব্যাখ্যা করি, তাহলে দেখা যাবে দুই ধরনের মানুষ আছে। এক- শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ আবার যাদেরকে আমরা এ্যালিড শ্রেণী মানে ধনীক শ্রেণী মনে করি তারা আছে। একটা মানুষের দেহের সাথে যদি তুলনা করি তাহলে শ্রমিক হচ্ছে এই হাত, এ্যালিড শ্রেণী যারা তারা হচ্ছে পেট।
তার মানে গল্পকার বলতে চেয়েছেন যে শ্রমিকরা সারা জীবন কাজ করে হাতের মতো কিন্তু যারা এ্যালিড শ্রেণীর এরাই মূলত খায় তাও কোন কাজ না করে। এটা একটা ছোট্ট অনুসরণ মাত্র। এর যতগুলো অধ্যায় আছে সেগুলোতে এরকম আলাদা আলাদা রূপকভাবে অর্থাৎ একটি কিশোরকে কীভাবে গল্প বোঝিয়ে বলা যায় সেইভাবে বলা হয়েছে।
পৃথিবীর কোন জিনিসই তুচ্ছ নয়। বইটির একটি গল্পে আছে – একবার এক কোটিপতি সওদাগর মরুভূমির মধ্যে বিপদে পড়ে, তখন একঘটি জল পেলে তার প্রাণ বাঁচে, ঐ সময় তার কাছে একঘটি জলের দাম কোটি টাকার চেয়ে বেশি। আরেক গল্পে আছে পৃথিবী যখন সূর্য থেকে প্রথম ঠিকরে এলো তখন পৃথিবীর অবস্থা সূর্যের মতোই – শুধু আগুন, জল নেই, পাহাড় নেই, মাটি নেই, গাছ নেই।
তারপর যতোই দিন যেতে লাগলো, ততোই বদলাতে লাগলো আগুনের এই ছোট্ট গোলাকার চেহারাটা। এমনি অজানা অনেক গল্প রয়েছে এই বইটিতে।
এসবটুকু বাদ দিলে জোরের সঙ্গেই বলা হয়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যে গল্পের শেষ নেই’ আবেদন শেষ হয়নি এখনো। কারণ, বাংলা ভাষায় এরকম সহজপাঠ্য বই খুব বেশি নেই বললেই চলে। তাই এই বইটি সবার জন্যই অবশ্য পাঠ্য।