মুঘলদের রামু বিজয়ের ঐতিহাসিক ইতিহাস (২য় পর্ব)

শিরুপন বড়ুয়া

আলমগীরনামাতে রামুকে একটি নৌ বন্দর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে যা চার দিনের পথ। তবে সেটা নৌ পথে। স্থলপথ ছিল খুবই দুর্গম। আরাকান শাসকদের কাছে কৌশলগত দিক থেকে রামু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ তাদের কাছে এটা ছিল স্থলপথে বাংলায় প্রবেশের পথ।

ইউরোপীয় পর্যটক রালফ ফিচ এর বর্ণনাতেও সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। রামুতে ছিল আরাকানিদের একটি দুর্গ, যেখানে বেশ বড়সড় সৈন্যবাহিনী নিয়ে রাজার প্রতিনিধি বসবাস করতেন। কার্যত রামু ছিল আরাকান রাজার অধীনে একটি শক্তিশালী প্রদেশ।

মুঘলদের রামু বিজয়ের ঐতিহাসিক ইতিহাস (১ম পর্ব)

১৫৮৩ থেকে ১৫৯১ সালের মধ্যে ভারতবর্ষ ভ্রমণ করা ফিচ এর মতে রামু’র রাজা (আরাকানি গভর্নর) ত্রিপুরার রাজার চেয়েও শক্তিশালী ছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেন ” The Mogen (Magh) which be of the kingdom of Recon (Arakan) and Rame (Ramu) be stronger then the king of Tippara, so that Chatigan or Porto Grande (Chittagong) is oftentimes under the king of Recon”

ভেনিসের পর্যটক নিকোলো ডি কন্টি সম্ভবত প্রথম কোন ইউরোপীয় ভ্রমণকারী যাঁর লেখায় রামু’র উল্লেখ আছে। কেননা তিনিই প্রথম ইউরোপীয় যিনি আরাকান এসেছিলেন ১৪২০ সালের শেষের দিকে। তাঁর লেখাতেও রামু আরাকান রাজার অধীনে একটি প্রদেশ ছিল বলে জানা যায়।

ইউরোপীয় পর্যটক ম্যানরিকের মতে রামু’র প্রাদেশিক গভর্নরকে বলা হতো ‘পোমাজা’। মুঘলরা যখন রামু আক্রমণ করে, তখন রামুতে পোমাজা হিসেবে ছিলেন ‘রাউলি’। ইনি ছিলেন আরাকান রাজা শ্রী চন্দ্র সুধর্ম্মা’র ভাই। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজ বংশ এবং তাদের সাম্রাজ্যের ইতিহাস পড়লে দেখা যাবে, গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলোতে কেন্দ্রীয় শাসকের নিকটতম আত্মীয়দের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রচলন সবসময় ছিল।

ম্যানরিক এবং রালফ ফিচ রামু’র রামকোটে আরাকান গভর্নরের বাসস্থান দেখতে পেয়েছিলেন। W.W. Hunter এর The Imperial Gazetteer এ রামুতে অবস্থিত ঐ আরাকান দুর্গটির অবস্থান বাকখালী নদীর দক্ষিণ পাড়ে রাজারকুল গ্রামে ছিল বলে উল্লখ করা হয়।

ইতিহাসবিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া রচিত ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইটিতে এ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার পর আমি নিজে রামকোট এলাকায় বন বিভাগের বিট অফিসের পাহাড়টিতে যাই। সেখানে একটি প্রাচীন অবকাঠামোর ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখতে পাওয়া যায়। এখানে যে ইট ব্যবহার করা হয়েছে তা সাধারণত বাংলা ইট নামে পরিচিত। এটা নিসন্দেহে ব্রিটিশ আমলের আগের স্থাপনা। যদিও এটাই সেই আরাকানি দুর্গ, তেমনটা বলার সময় এখনো আসে নি। কারণ পর্যাপ্ত খনন এবং গবেষণা না করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটা বোকামি হবে।

যাই হোক, আরাকান দুর্গটি দখলের জন্য বুজুর্গ উমেদ খান মীর মুর্তজাকে প্রেরণ করলেন। আগেই বলেছি, স্থলপথে চট্টগ্রাম হতে রামু আসার পথটি বেশ দুর্গম। বিশেষ করে চকরিয়ার অংশটুকু ছিল ঘন জঙ্গল। তাছাড়া এই জঙ্গল আবার হিংস্র প্রাণীতে পরিপূর্ণ। এছাড়াও ছোট বড় নদী তো আছেই।

মীর মুর্তজা ১২ দিন পর রামু থেকে মাত্র এক মাইল দূরে এসে উপস্থিত হলেন। শায়েস্তা খানের আদেশে ঢাকা ছাড়ার আগে মীর মুর্তজা কেন হাজারের অধিক কুঠার সংগ্রহ করেছিলেন তা নিশ্চয় পাঠকরা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন।

জানুয়ারি মাসের ২৬ তারিখ যদি চট্টগ্রামের পতন হয়, এবং মীর মুর্তজা যদি এর পরপরই রামু অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন, তাহলে অনুমান করা যায় তিনি আনুমানিক ১৬৬৬ সালের ফেব্রুয়ারির ৮ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে রামু এসে পৌঁছান।
রামুতে পৌঁছে পরদিন সকালেই তিনি রামকোটে আরাকান দুর্গে হামলা করেন।

আরাকান রাজা শ্রী চন্দ্র সুধর্ম্মার ভাই রাউলি বিরত্বের সাথে তাঁর দুর্গটি মুঘলদের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। আলমগীরনামাতে রাউলির বিরত্বের কথা লিপিবদ্ধ আছে। পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, চট্টগ্রাম অভিযানে আসা মুঘলদের গোলন্দাজ বাহিনীর একজন কমান্ডার ছিলেন মীর মুর্তজা।

তাঁর ভারী কামানের গোলার আঘাতে রামু দুর্গের পতন হয়। রাউলি তাঁর সৈন্য নিয়ে রামু দুর্গের পাশেই পাহাড়ি ঘন জঙ্গলে আত্মগোপন করেন।

রামু বিজয়ের খবর চট্টগ্রামে অবস্থান করা উমেদ খানের নিকট পৌঁছে যায়। তিনি এটাও জানতে পারেন যে, রামু পুনরায় দখলের জন্য আরাকান রাজার একটি বড় সেনা বহর স্থলপথে রামু অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। উমেদ খান তাই রামুতে অবস্থান করা মির মুর্তজার শক্তি বৃদ্ধির জন্য চট্টগ্রাম থেকে মিঞা খান, এবং জামাল খানকে প্রেরণ করলেন।

বি:দ্র: লেখাটি রামু’র ইতিহাস বিষয়ক গবেষণার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। মুঘলদের রামু বিজয়ের ঐতিহাসিক ইতিহাস ২য় পর্ব প্রকাশিত হলো। ধারাবাহিক পর্ব পড়তে চোখ রাখুন জ্ঞানান্বেষণ পাঠাগার’র সাহিত্য ও শিল্প পাতায়। ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

তথ্যসূত্র-
১। মুহম্মদ এনামুল হক,আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, আরকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য, চট্টগ্রাম ১৯৩৫।
২। শ্রীপূর্ণচন্দ্র চৌধুরী, চট্রগ্রামের ইতিহাস, চট্রগ্রাম, ১২৮২ মগী।
৩। আহমদ শরীফ,চট্রগ্রামের ইতিহাস, ঢাকা, ২০০১।
৪। জামাল উদ্দিন, শাশ্বত চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, ২০১৫।
৫। W Foster, Early Travels in India 1583-1619, Oxford University Press, 1921.
৬। Jadunath Sarkar, Anecdotes of Aurangzib and Historical Essays, Calcutta, 1917.
৭। The Calcutta Review, Vol.53, Calcutta, 1871.
৮। Anjali Chatterjee, Bengal in the Reign of Aurangzib.
৯। L.S.S O’mey, Eastern Bengal District Gazetteers-Chittagong, Calcutta 1908.
১০। W.W. Hunter, The Imperial Gazetteer, Vol.3, London, 1885.
১১। Shunati Bhusan Qanungo, A History of Chittagong Vol 1, Chittagong.
১২। Sir Arthur P Pyre, History of Burma, London, 1883.
১৩। G.E Harvey, History of Burma, Calcutta, 1925.
১৪। W.W Hunter, A Statistical Account of Bengal, Vol. 6, London, 1876.
১৫। Dr. Mohamed Ali, Bengal-Arakan Relations: A Study in Historical Perspective.
১৬। Aye Chan, The Kingdom of Arakan in the Indian Ocean Commerce (Ad 1430-1666), Kanda University of International Studies, Japan.

লেখক: শিরুপন বড়ুয়া, আইনজীবী ও তরুণ ইতিহাস বিশ্লেষক।
shirubarua@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *