ধনিরাম বড়ুয়া
নতুন পাড়ার একেবারে শেষ প্রান্তে বাদলদের বাড়ি। তাদের বাড়ির পাশে বিস্তীর্ণ শস্য ক্ষেত। তারও পরে বিরান প্রান্তর। বাদলের বাবা পাঁচ বছর হল ভুতের কবলে পড়ে মারা গেছে। বর্তমানে বাদল আর মা ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। অভাবের সংসার। মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে। বাদলও গ্রামের জমিদার বাড়িতে রাখালের কাজ করত।
বেতন মাসে ত্রিশ টাকা। সম্প্রতি ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হলে জমিদার তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সেই থেকে সে বাড়িতে। প্রায় মাসাধিক কাল জ্বরে ভুগেছে। দুর্বলতায় মুখ চোখ বসে গেছে। মাথার চুলও অর্ধেকটা উঠে গেছে। তার কিশোর বয়সের রোগা চেহারাটা দেখলে মায়া হয়। একদিন সে পাড়ার মসজিদের সামনে দাঁড়িয়েছিল। এক অচেনা মানুষ মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বের হয়ে তাকে দুটা ভাপা পিঠা খেতে দিল।
বাদল খুব খুশি হল। সে পিঠা দুটো মায়ের কাছে নিয়ে এল। উঠান থেকে ডাক দিয়ে বল্ল-“ মা, একজন লোক আমাকে দু’টা পিঠা খেতে দিয়েছে।“মা সেদিকে না তাকিয়েই বল্ল-“ একটা খাও, আর একটা মাটিতে রুয়ে দাও।”
বাদল একটা পিঠা খেল। অন্যটা ভিটার সীমানায় মাটি খুঁড়ে রুয়ে দিল। কদিন পর দেখা গেল সত্যি সত্যি পিঠা থেকে একটা গাছ গজিয়েছে এবং অল্পদিনের মধ্যে গাছটি ডালপালা মেলে বড় হয়ে উঠল।
একদিন সকালে বাদল দেখল সারাগাছে থোকা থোকা পিঠা ধরেছে। দেখে বাদলের খুশির অন্ত নেই। সে সারাদিন গাছে চড়ে বসে থাকে, আর ক্ষুধা পেলে পেট পুরে পিঠা খায়। এভাবেই বাদলের দিন কাটে। একদিন বাদল গাছে বসে পিঠা খাচ্ছিল। এমন সময় এক বুড়ি এসে গাছের নীচে থামল। বুড়ির হাতে ছিল একটি খালি পাটের বস্তা।
বাদল ভাবল বৃদ্ধাটি ঘুঁটে কুড়োনী হবে। বুড়ি বলল-“ ও নাতি, আমাকে একটা পিঠা দাওনা।” বাদল ভাবল বুড়িটি হয়ত ক্ষুধার্ত। একটা পিঠা দিলে মন্দ কি! সে একটা পিঠা ছুড়ে দিল। পিঠাটি মাটিতে পড়ল। বুড়ি বল্ল-“ ও নাতি, পিঠাখানা তো মাটিতে পড়ল, খাব কেমন করে? একটা হাতে হাতে দাওনা ভাই।” বাদল আর একটা পিঠা ছিঁড়ে যেই হাতে হাতে দিতে গেল, অমনি বুড়ি তাকে খপ করে নীচে নামিয়ে আনল, এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে বস্তার ভেতর ঢুকিয়ে কাঁধে তুলে চলতে শুরু করল। চলতে চলতে অনেকদূর গিয়ে বুড়ির পানির তেষ্টা পেল।
বুড়ি বস্তাটাকে রাস্তার পাশে রেখে কিছু দূরে প্রবাহিত বাকখালী নদীতে পানি পান করতে গেল।
এমন সময় সে পথ দিয়ে দুজন লোক আলাপ করতে করতে আসছিল। মানুষের আগমন টের পেয়ে বাদল বস্তার চিৎকার করতে শুরু করল।
লোক দু’জন অবাক হয়ে বস্তার কাছে গেল, এবং বস্তার বাঁধন খুলে বাদলকে মুক্ত করে দিল। বাদলের কাছে সব কথা শুনে তারা মজা করার জন্য বস্তার ভেতর কিছু মাটির ঢেলা ও কিছু কুল কাঁটা ঢুকিয়ে দিয়ে বস্তার মুখটা ঠিক আগের মত বন্ধ করে রেখে তাড়াতাড়ি সে স্থান ত্যাগ করল।
বুড়ি নদী থেকে জল পান করে এসে বস্তাটি পিঠে তুলে চলতে আরম্ভ করল। কিছুদূর পথ চলার পর বুড়ি পিঠে মাটির ঢেলার আঘাত পেল। বুড়ি তখন বল্ল-“ ও নাতি, পিঠে ঘুষি মারছ নাকি? ঠিক আছে, আজ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খুব মজা করে তোকে খাব।” আর কিছুদূর গিয়ে বুড়ি পিঠে কাাঁটা ফুটল।
বুড়ি তখন বেদনায় উহু করে উঠল। বল্ল-“ ও নাতি, চিমটি কাটছ তো? কাট কাট, আর কদ্দুরই বা পথ, এখন বাড়ি গেলে অবস্থা টের পাবে।”আসলে বুড়িটি ছিল একটা রাক্ষসী। বনের ভিতর তার বাড়ি। বুড়ির একটা নাতনী আছে। তার মানুষের মাংস খাওয়ার খুব ইচ্ছে হয়েছে। তাই সে বুড়ি দাদীকে বহুদিন ধরে বিরক্ত করে আসছিল।
বুড়ি নাতনীর ইচ্ছা পূরণের জন্য আজ বাদলকে অনেক কায়দা করে ধরে এনেছে। বুড়ি বাড়িতে পৌঁছে বস্তাটি রাখল। বস্তার মুখ খুলেই দেখতে পেল ওখানে মানুষ নেই। তার পরিবর্তে কতগুলো মাটের ঢেলা ও কাঁটা। তখন বুড়ি কপালে হাত দিয়ে আফসোস করতে লাগল-“আহারে, আমি কেন পানি খেতে গেলাম!”
আরো কিছুদিন পরের কথা। বাদল ঠিক আগের মতই পিঠা গাছে বসে পিঠা খাচ্ছিল। এমন সময় এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে এসে বাদলের কাছে একখানা পিঠা খেতে চাইল। মেয়েটির খুব ক্ষিধে পেয়েছে ভেবে বাদলের মায়া হল। সে একখানা পিঠা ছুুঁড়ে দিল। মেয়েটি পিঠাখানা ধরতে না পারায় মাটিতে পড়ে গেল। মেয়েটি কোমল স্বরে বলল-“দেবে যদি ভাই হাতে হাতেই দাও। বাদল একখানা পিঠা হাতে হাতে দিতে গেল।
অমনি মেয়েটি বাদলের হাত ধরে টেনে নামাল। মুহূর্তেই মেয়েটি আগের সেই বৃদ্বা নারীতে পরিণত হল এবং দ্রুত গতিতে বাদলকে বস্তার ভিতর ঢুকিয়ে কাঁধে তুলে চলতে শুরু করল। বাদল প্রাণপণে ডিচৎকার করল। বাদল প্রাণপণে চিৎকার করল, মানুষের কাছে সাহায্য চাইল।
কিন্তু তার কন্ঠ দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। বস্তা থেকে বের হওয়ার জন্য হাত পা ছুঁড়ে অনেক চেষ্টা করল, তবে বুড়ির রাক্ষুসে শক্তির সাথে কিছুতেই পেরে উঠলনা। আজ আর বুড়ি পথে একবারের জন্যও থামল না। সোজা ঘরে গিয়ে বস্তা নামাল।
বুড়ি নাতনিকে ডেকে বলল-“ওরে আমার আদরের নাতনি, আজ তোর মনের আশা পূর্ণ হল। বেশ নাদুস নুদুস মানুষের বাচ্চা পেয়েছি রে! নাতনি বল্ল-“ ভালই হল দাদী, আজ খুব মজা করে খাব।” বুড়ি বল্ল-“ ঠিক আছে। আমি তোর নানা নানীকে রাতের খাবারের জন্য নেমন্তন্ন করে আসি। ততক্ষণে তুই ছেলেটাকে কেটে কুটে ভাল করে রান্না করে রাখ।” এই বলে বুড়ি বনের অন্য প্রান্তে বসবাসকারী নানা নানীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
বস্তার ভেতর থেকে বাদল সব কথা শুনল এবং মনে মনে ভাবতে থাকল কীভাবে এখান থেকে পালানো যায়। বুড়ির নাতনীটি ছিল দশ বছরের। কিন্তু তার শরীর ছিল বয়সের তুলনায় যুবতী মেয়ের মত। সে বস্তার মুখটি খুলে বাদলকে বের করল। বাদল উঠে দাড়িয়ে মেয়েটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি তার চাহনি দেখে আশ্চর্য হয়ে বল্ল-“ কি দেখছ অমন করে?”
বাদল বলল-“ বোন, তুমি খুব সুন্দরী। তোমার মত সুন্দরী মেয়ে কোথাও নেই। তুমি যদি আমাদের লোকালয়ে যেতে তবে তুমি রাজপুত্রকে বিয়ে করতে পারতে।” বিয়ের কথায় মেয়েটির মুখ লাল হয়ে উঠল। কিন্তু মনে মনে আনন্দিত হল। রাজপুত্রের সাথে বিয়ে! সে কি চারটি খানি কথা।
দাদীর মুখে রাজপুত্রের গল্প শুনেছিল বটে, কিন্তু চোখে দেখেনি। মনে মনে ভাবল, এই ছেলেটি যদি সহায় হয় তবে এর সাথে পালিয়ে গেলে রাজপুত্রকে হয়ত পেতে পারে। জিজ্ঞাসা করল-“ রাজপুত্ররা বুঝি খুব সুন্দর?” বাদল চোখে মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বল্ল-“সুন্দর মানে? দেখলে চোখ ফেরাতে পারবে না। আর তাদের সোনার ঘর, সোনার বাড়ি, একবার গেলে ফিরে আসতে চাইবে না।” মেয়েটি কেমন যেন আবেগে বিমনা হয়ে গেল।
মনে মনে কি যেন ভেবে বলল-“তোমার বুঝি রাজপুত্রের সাথে প্রায়ই দেখা হয়?” বাদল বলল-“প্রতিদিন দেখা হয়। ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্র বেড়াতে যায় কিনা? তোমাকে দেখলে ঠিক পছন্দ করবে।” মেয়েটি ভাবল ছেলেটির সঙ্গে গিয়ে যদি একবার রাজপুত্রকে দেখে আসতে পারত!
কিন্তু দাদী আসার আগেই তো ছেলেটাকে কেটে কুটে রান্না করতে হবে। সে যে এত সুন্দর এমন কথাও কোনদিন কারো মুখে শুনেনি। সে নিজেও নিজের সম্বন্ধে জানতে পারেনি। ছেলেটার কথা শুনে নিজের রুপ সম্বন্ধে একটা ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে মনে মনে।
সে বাদলের হাত ধরে বলল-“ওগো, ভাল করে দেখে বল তো! আমি কি খুব সুন্দর?” বাদল নিজেকে বাঁচানোর জন্য একটা কথার কথা বলেছিল মাত্র। রুপের প্রশংসা শুনে তাকে যদি মুক্ত করে দেয়, অথবা কোন ফন্দি ফিকির করে পালাতে পারে তার জন্য একটা পথ খুঁজতে চেয়েছিল।
কিন্তু মেয়েটি যে এত সহজে সেটা বিশ্বাস করে বসবে তা সে ভাবেনি। সে বুঝতে পারল মেয়েটি অনেকটা তার প্রতি সদয় হয়েছে। সে আরো প্রিয় হওয়ার জন্য বলল-“ সত্যি, অপূর্ব সুন্দরী। বনের ভেতর তোমাকে মানায় না।” এই বলে সে তার গালে একটা টোকা দিয়ে হাসল।
বাদলের হাসিতে সাদা দাঁতের ঝিলিক দেখে মেয়েটি আশ্চর্য হল। দাঁত যে এত সুন্দর হতে পারে তা সে কোনদিন ভাবেনি। অথচ তার দাঁতগুলো যেন কেমন! সে বাদলকে বলল-“ তোমার দাঁত খুব সুন্দর। দাঁতে কি দিয়েছ?” বাদল এবার সুযোগ বুঝে বলল-“ কোদাল পোড়া। তুমি দেবে? তোমার দাঁতও খুব সুন্দর হবে।” মেয়েটি বলল-“ ওগো তাই, একবার আমাকে দাওনা। আমাদের একটা কোদাল তো আছে।
” বাদল বলল-“ ঠিক আছে, কোদাল পোড়াটা দাও।” বাদলের কথামত মেয়েটি আগুন জ্বালাল। বাদল যত্ন করে কোদালটির মুখখানা আগুনে পুড়ে লাল করে নিল। তারপর মেয়েটিকে বলল-“ তুমি শুয়ে হা কর, আমি তোমার দাঁতে লাগিয়ে দেই।” মেয়েটি সত্যি সত্যি শুয়ে পড়ে হা করল।
বাদল কোদালটার কাঠ ধরে মেয়েটির মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে চেপে ধরল জোরে। আর ভিষণ যন্ত্রণায় ছটফট করে অল্পক্ষণের মধ্যে মারা গেল। ওদিকে রাক্ষসী বুড়িটি ফিরে আসার সময় হয়েছে ভেবে বাদল মেয়েটির একটি শাড়ি পরে কাঁকালে একটা কলসি নিয়ে পানি আনার ছল করে পাশের নদীতে গেল। আর কেউ আসার আগে নদী পার হয়ে অনেক দূরে চলে গেল। এভাবে বাদল প্রাণে রক্ষা পেল।