লিটন বড়ুয়া
আলোকিত যে মানুষটা সম্পর্কে কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করব চিন্তা করছি, সেটা যে কিভাবে শুরু করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। কারন তিনি প্রাচীন ভারতবর্ষ তথা এই বাংলার মানুষের কাছে রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ হিসেবে বিবেচিত হলেও, তিব্বতের মানুষ উনাকে ভগবান/ঈশ্বর হিসেবে দেখত এবং তাদের হৃদয়ে মহামতি বুদ্ধের পরেই তাঁর স্থান ছিল।
ভারতবর্ষের মানুষ উনাকে ডাকতো অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান নামে, যার অর্থ হল চির জাগ্রত জ্ঞানদীপ। অন্যদিকে তিব্বতের মানুষ উনাকে ডাকতো “জোবোজে’’ নামে যার অর্থ হল “দা নোবেল লর্ড’’ অর্থাৎ মহৎ প্রভু। ২০১৪ সালে বিবিসি কর্তৃক জরিপকৃত সর্বকালের সেরা একশো বাঙ্গালীর মধ্যে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিল আঠারোতম।
খুবই আশ্চর্যজনকভাবে অতীশ দীপঙ্কর নামের যে মানুষটি জ্ঞান ও পান্ডিত্য দিয়ে তাঁর সময়কালকে সমৃদ্ধ ও আলোকিত করেছিল, তাঁর নাম, ইতিহাস এবং অবদান এই অঞ্চলের জনমানুষের স্মৃতি থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর দীর্ঘসময় পর বর্তমান চট্টগ্রামের সন্তান শরৎচন্দ্র দাশ তিব্বতি ভাষা ও সংস্কৃতির স্কলার এবং তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের তিব্বত বিষয়ক কূটনীতিক হিসেবে ১৮৮১ ও ১৮৮৪ সালের দিকে তিব্বত ভ্রমন করেন।
তিব্বত ভ্রমনের অভিজ্ঞতার উপর তিনি “Indian Pandits In The Land of Snow” নামে একটি বই লিখেন, যে বইয়ের মারফতে অতীশ দীপঙ্কর সম্পর্কে আমরা প্রথমবারের মতন জানতে পারি। এছাড়া মহাপন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের তিব্বতযাত্রা এবং তিব্বত বিষয়ক লিখিত বইগুলোও অতীশ দীপঙ্কর সম্পর্কে আমাদের খোঁজ খবর দেয়। ধীরে ধীরে পুনঃআবিস্কার হতে থাকে অতীশ দীপঙ্কর ও তাঁর কর্মযজ্ঞ।
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জন্ম বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে যেটা বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। যে স্থানে উনার বসতবাড়ি ছিল, সেই স্থান নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা হিসেবে জনসাধারণের মুখে মুখে প্রবাহমান। ধারণা করা হয় নাস্তিক বিশেষণটা অতীশ দীপঙ্কর অর্জন করেছিল তাঁর বংশগত ধর্ম এবং রীতিনীতি ত্যাগ করার কারণে।
গৌড়িয় রাজবংশের রাজা কল্যাণ শ্রী এবং রানী প্রভাবতী দেবীর সংসারে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান জন্ম নিয়েছিল আনুমানিক ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে। উনার পারিবারিক নাম ছিল শ্রী চন্দ্রগর্ভ। পদ্মগর্ভ এবং শ্রীগর্ভ ছিল শ্রী চন্দ্রগর্ভের অপর দুই ভাই। তিন ভাইয়ের মধ্যে চন্দ্রগর্ভ ছিলেন দ্বিতীয়।
অতীশ খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেন। কথিত আছে তার পাঁচ স্ত্রীর গর্ভে মোট ৯টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তবে পুন্যশ্রী নামে একটি পুত্রের নামই শুধু জানা যায়। মহামতি গৌতম বুদ্ধ যেমন রাজসুখ ও বিলাসী জীবন ত্যাগ করে দুঃখ থেকে মুক্তির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল ঠিক তেমনি চন্দ্রগর্ভও রাজপ্রসাদ ছেড়ে জ্ঞানের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছিল প্রাচীন ভারতবর্ষসহ সুবর্ণদ্বীপ, জাভা, সুমাত্রা দ্বীপে যা বর্তমানে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত।
জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি অর্জিত জ্ঞান বিতরনের জন্য গমন করেছিল নেপাল, শ্রীলংকা ও তিব্বতে। দশম এবং একাদশ শতাব্দীর পুরোটা সময় জুড়ে বৌদ্ধ দর্শনের পুনঃপাঠ/বিনির্মাণ এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে অতীশ দীপঙ্কর ছিল উজ্জ্বলতম নক্ষত্র কিংবা তৎকালীন সেলিব্রেটি ব্যক্তিত্ব বললেও ভুল হবে না।
বার্ধক্য, ব্যাধি এবং মৃত্যুর শাশ্বত দৃশ্যবলী যেমন রাজপুত্র সিদ্ধার্থকে ভাবিয়ে তুলেছিল জীবন ও জগত সম্পর্কে, পাশাপাশি একজন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর নির্মল চিত্ত ও অবয়ব সিদ্ধার্থকে মুক্তির পথনির্দেশনা দিয়েছিল ঠিক তেমনি রাজপ্রসাদের অভ্যন্তরে ও বাইরে মানুষের সাথে মানুষের নির্মম শ্রেণী বৈষম্য, ঊর্ধ্বতন কর্তৃক অধস্তনদের উপর বৈষম্যমূলক ব্যবহার রাজকুমার চন্দ্রগর্ভকে ভাবিয়ে তুলেছিল।
কারণ তিনি মানুষের সাথে মানুষের ভেদাভেদ তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। অহংবোধ থেকে ভেদাভেদের উৎপত্তি। তাই তিনি রাজপুত্র হয়েও রাজকর্মচারী এবং প্রজাদের সাথে পরম আত্মীয়ের মতন ব্যবহার করতেন। তাঁর এই ধরনের বৈষম্যহীন আচরণের কারনে চন্দ্রগর্ভকে নানারকম তিক্ত সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
শিক্ষা জীবনের প্রথমদিকে চন্দ্রগর্ভ তান্ত্রিক সাধনার প্রতি আকৃষ্ট ছিল। ১৫ বছর বয়সে রাহুলগুপ্ত নামক একজন তান্ত্রিক-গুরুর অধীনে ইয়োগা ও তান্ত্রিকতার উপর জ্ঞান অর্জন করেন। এখানে তিনি গুহ্যজ্ঞানবজ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন যার অর্থ হল অবিনশ্বর জ্ঞান। এরপর একটা পর্যায়ে এসে, তিনি তৎকালীন বিখ্যাত ধর্মীয় গুরু জেতারির অধীনে বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ এবং বৌদ্ধধর্মের উপর শিক্ষালাভ শুরু করে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধ্যাত্মিক গুরু বোধিভদ্রের কাছে বোধিচিত্ত বিষয়ক জ্ঞান লাভ করেন। বোধিচিত্ত হল করুনাসিক্ত এবং ভালবাসায় পরিপূর্ণ এমন একটি মন যা সকল জীবের কল্যাণের জন্য আলোর সন্ধান করে। এরপর তিনি বোধিভদ্রের গুরুদেব অবধূতি পাদের নিকট মাধ্যমিক মধ্যমপন্থা বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন।
চন্দ্রগর্ভ মগধের (বর্তমানে ভারতের বিহার রাজ্য) ওদন্তপুরী মহাবিহারের মহাসাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে উপসম্পদা দীক্ষা গ্রহনের ইচ্ছা পোষণ করলে উনি চন্দ্রগর্ভকে লক্ষ্য করে বলেন- শ্রমন জীবন সুকঠিন, এই জীবনে স্থির হতে হলে পূর্ব-পরিচিত তন্ত্র সাধনার সাথে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক রাখা যাবে না।
অতঃপর শর্তপূরণ সাপেক্ষে এবং পান্ডিত্য প্রমানের ভেতর দিয়ে কোন এক বৈশাখী পূর্ণিমার তিথিতে চন্দ্রগর্ভ শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন, পাশাপাশি চন্দ্রগর্ভ ও গুহ্যজ্ঞানবজ্র পদবীর চির অবসান ঘটান এবং অতীশ দীপঙ্কর নামে আবির্ভূত হন।
আচার্য শীলরক্ষিতের অধীনে অতীশ দীপঙ্কর দ্বাদশ নিধান যথা অবিদ্যা, সংস্কার, বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব, জাতি, দুঃখ সম্পর্কে বিশাদ জ্ঞান অর্জন করেন। শীলরক্ষিতের নিকট বিনয় পিটকের পাঠ গ্রহনে অতীশ দীপঙ্করকে সর্বাধিক শ্রম দিতে হয়েছিল।
এছাড়া হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের প্রধান প্রধান সাহিত্য, দর্শন, আর্টস এবং মেডিসিন নিয়ে অধ্যয়ন করেন যা তাঁকে জ্ঞানের সামগ্রিকতা অনুধাবনে সহায়তা করেছিল। শীলরক্ষিতের নিকট সমস্ত পাঠ গ্রহন শেষ করে তাঁর পরামর্শ অনুসারে অতীশ দীপঙ্কর বিশুদ্ধ মহাযান মতবাদ এবং আলয় বিজ্ঞান সম্পর্কে জানার জন্য ১০১১ খ্রিস্টাব্দে ৩২ বছর বয়সে শতাধিক শিষ্যসহ বণিকদের জাহাজে করে সুবর্ণদ্বীপে (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া) গমন করেন এবং আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ দর্শন শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করেন এবং একত্রিশ বছর বয়সে তিনি আচার্য ধর্মরক্ষিত কর্তৃক সর্বশ্রেষ্ঠ ভিক্ষুদের শ্রেণীভুক্ত হন।
ইন্টারেস্টিং বিষয় হল আচার্য ধর্মকীর্তি নিজেও গৃহীজীবনে শৈলেন্দ্রবংশীয় একজন রাজপুত্র ছিলেন।
পরবর্তীতে তিনি ভিক্ষু জীবনে ব্রত হয়ে সুবর্ণদ্বীপে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন এবং ভারতবর্ষের সাথে সুবর্ণদ্বীপের বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ধর্মকীর্তির অধীনে অতীশ দীপঙ্কর মাধ্যমিক বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। বিশ্বসংসার পরস্পর নির্ভরশীল। ব্যক্তি বা বস্তু, কোন কিছুই স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল নয়। একটি গোলাপ মূলত জল, বায়ু, মাটি এবং সূর্যের তাপের সমন্বয় ফুটে।
এই চারটি উপাদানকে যদি গোলাপের অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় তবে গোলাপ নামে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং বলা যায়, গোলাপ নামক যে ফুল আমি দেখি তা মূলত শুন্য। অন্যদিকে যে “আমি’’ গোলাপটা দেখছি/প্রত্যক্ষন করছি সেই ‘আমি’ মূলত রূপ (শরীর), বেদনা (সুখ, দুঃখ, নিরপেক্ষ অনুভূতি), সংজ্ঞা (নির্দিষ্ট উপাদানকে নির্দিষ্ট নামে চিহ্নিতকরণের মানসিক প্রক্রিয়া), সংস্কার ( ভালো- মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের ধারনা যে উৎস থেকে উৎপত্তি হয়), বিজ্ঞান ( সত্ত্বা জুড়ে সদা প্রবাহমান চেতনা) নামক পঞ্চস্কন্ধের সমন্বয়। এই পঞ্চস্কন্ধের পাঁচটি উপাদান আবার একে অপরের উপর নির্ভরশীল এবং সদা পরিবর্তনশীল।
সদা পরিবর্তনশীল এবং পারস্পরিক নির্ভরশীল এই পাঁচটি উপাদানকে ‘আমি’ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে মূলত ‘আমি’ বলতে আর কিছুই থাকে না, যা থাকে তা হল শুন্য। সুতরাং আমি মানেই হল শুন্য। অতঃপর আমিটাও শুন্য এবং গোলাপটাও শুন্য হওয়া সত্তে¡ও আমি গোলাপটাকে দর্শন করি, অনুভব করি।
শুন্য হওয়া সত্ত্বেও “আমি-প্রত্যক্ষন-গোলাপ’’ এর সামগ্রিক সম্পর্কটা চেতনার যে উৎস থেকে উদ্ভুত হয় তাকে আলয়-বিজ্ঞান বলে। যে মানব অনুধাবন করে যে, দুঃখ তাঁর একার নয়, বন্ধন তাঁর একার নয়, দুঃখ-বন্ধন সকলের এবং সকলের মুক্তির জন্য প্রানান্তর চেষ্টা করে, অন্যের মুক্তি না হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের মুক্তিকে স্থগিত রাখে তাকেই বোধিসত্ত¡ বলে যার ভেতরে বোধিচিত্ত সদা জাগ্রত থাকে।
এটিই প্রকৃত অর্থে ভগবান বুদ্ধ প্রচারিত আদর্শ। এভাবেই অতীশ দীপঙ্কর ধর্মকীর্তির কাছ থেকে মহাযান মতবাদ সম্পর্কে গভীর শিক্ষা লাভ করার পর ৪৩ বছর বয়সে তিনি পুনরায় ভারতবর্ষের মগধে ফিরে আসেন যেখান থেকে তাঁর জ্ঞান আহরণের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মগধের তৎকালীন প্রধান প্রধান মতবাদের প্রধান প্রধান পন্ডিতদের সঙ্গে অতীশ দীপঙ্করের বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় ও বিতর্ক হয়।
বিতর্কে তাঁর বাগ্মিতা, যুক্তি ও পান্ডিত্যের কাছে তাঁরা পরাজিত হন। এভাবে ক্রমশ তিনি একজন অপ্রতিদ্বন্ধী পন্ডিতের স্বীকৃতি লাভ করেন। এ সময় পালরাজ প্রথম মহীপাল সসম্মানে তাঁকে বিক্রমশিলা মহাবিহারের আচার্যপদে নিযুক্ত করেন যা বর্তমানে ভাগলপুর, বিহার রাজ্যের অন্তর্গত। বিক্রমশিলাসহ ওদন্তপুরী ও সোমপুর বিহারে অতীশ দীপঙ্কর ১৫ বছর অধ্যাপক ও আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন।
সোমপুর বিহারে অবস্থানকালেই তিনি মধ্যমকরত্নপ্রদীপ গ্রন্থের অনুবাদ করেন বলে ধারনা হয় যা বৌদ্ধ সাহিত্যের একটি অমূল্য রতন। এই সময় মহীপালের পুত্র নয়পালের সঙ্গে কলচুরীরাজ লক্ষমীকর্ণের যে যুদ্ধ হয়, দীপঙ্করের মধ্যস্থতায় তার অবসান ঘটে এবং দুই রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়।
তিব্বত গমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তিব্বত গমন ছিল অতীশ দীপঙ্করের শ্রীজ্ঞানের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য টারনিং পয়েন্ট। তিব্বতের বৌদ্ধ রাজা লাঃ লামা ইয়োসি হোড্ তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের উন্নতি কামনায় অতীশ দীপঙ্করকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার আশায় রাজকীয় আমন্ত্রনপত্রসহ স্বর্ণোপহার দূতের মাধ্যমে বিক্রমশীলায় প্রেরণ করেন। দূত জানান যে, তিনি তিব্বতে গেলে তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান জানানো হবে।
বয়সের সীমাবদ্ধতা এবং ভারতবর্ষের মানুষের কাছে তাঁর ব্যক্তিগত অঙ্গীকারকে বিবেচনায় রেখে অতীশ দীপঙ্কর এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। রাজা লাঃ লামার মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র চ্যাং চুব জ্ঞানপ্রভ তিব্বতের রাজা হন এবং তাঁর একান্ত অনুরোধে ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে কয়েকজন বিশিষ্ট পন্ডিতসহ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ৬০ বছর বয়সে বুদ্ধগয়া হয়ে তিব্বতের পথে যাত্রা করেন। যাত্রাপথে নেপালের রাজা অনন্তকীর্তি দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে বিশেষভাবে সংবর্ধিত করেন এবং তাঁর অনুরোধে তিনি নেপালে এক বছর অবস্থান করেন।
তিনি সেখানে ‘খান-বিহার’ নামে একটি বিহার স্থাপন করেন এবং নেপালের রাজপুত্র পদ্মপ্রভকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করে ঐ বিহারের দায়িত্বভার প্রদান করেন। তিব্বতরাজ চ্যাং চুব দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের শুভাগমন উপলক্ষে এক রাজকীয় সংবর্ধনার আযয়োজন করেন যার দৃশ্য সেখানকার একটি মঠের প্রাচীরে আজও আঁকা আছে।
এই সময় রাজা চ্যাং চুব প্রজাদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন যে, অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতের মহাচার্য ও ধর্মগুরু হিসেবে মান্য করা হবে। তিব্বতের থো-লিং বিহার ছিল দীপঙ্করের শ্রীজ্ঞানের মূল কর্মকেন্দ্র। এখান থেকেই তিনি তিব্বতের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিব্বতের বৌদ্ধধর্ম থেকে তান্ত্রিকতা, বৌদ্ধ মতবাদের সাথে সাংঘর্ষিক এমন জীবনচর্চা দূর হয় এবং বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মাচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
তিব্বতে তিনি মহাযান মতবাদ অনুসারে বৌদ্ধধর্মের সংস্কার সাধন করেন এবং বৌদ্ধ কদম (গেলুক) সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিব্বতবাসীরা তাঁকে বুদ্ধের পরেই শ্রেষ্ঠ গুরু হিসেবে সম্মান ও পূজা করে এবং মহাপ্রভু হিসেবে মান্য করে। তিব্বতের রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় ক্ষমতার অধিকারী দালায় লামারা নিজেদের অতীশ দীপঙ্করের শিষ্য এবং উত্তরাধিকারী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
দানপ্রাপ্ত অর্থ দিয়ে অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতের একটি নদীতে বাঁধ দিয়ে বন্যা প্রতিরোধের মাধ্যমে জনহিতকর কাজেও অংশগ্রহণ করেন। অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতের ধর্ম, রাজনীতি, জীবনীগ্রন্থ, “স্তোত্রনামাসহ ত্যঞ্জুর” নামে এক বিশাল শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন।
তাই অতীত তিব্বতের যেকোনো বিষয়ের আলোচনা অতীশ দীপঙ্করের সৃষ্টিকর্ম ছাড়া সম্ভব নয়। তিনি দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। এসব গ্রন্থ তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে সহায়ক হযয়েছিল। তিব্বতে তিনি অনেক সংস্কৃত পুথি আবিষ্কার করেন এবং নিজহাতে সেগুলির প্রতিলিপি তৈরি করে বঙ্গদেশে পাঠান। অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ তিনি ভোট (তিব্বতে) ভাষায় অনুবাদও করেন।
তিব্বতি ভাষায় তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা এবং কারিগরি বিদ্যা সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর মূল সংস্কৃত ও বাংলা রচনার প্রায় সবগুলিই কালক্রমে বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু তিব্বতি ভাষায় সেগুলির অনুবাদ সংরক্ষিত আছে। তিব্বতি মহাগ্রন্থ ত্যঞ্জুরে তাঁর ৭৯টি গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ সংরক্ষিত আছে।
তাঁর রচিত প্রধান কয়েকটি গ্রন্থ হলো: বোধিপথপ্রদীপ, চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ, সত্যদ্বয়াবতার, বোধিসত্ত¡মান্যাবলি, মধ্যমকরত্নপ্রদীপ, মহাযানপথসাধনসংগ্রহ, শিক্ষাসমুচ্চয় অভিসাম্য, প্রজ্ঞাপারমিতাপিন্ডার্থপ্রদীপ, একবীরসাধন, বিমলরত্নলেখ প্রভৃতি। বিমলরত্নলেখ মূলত মগধরাজ নয়পালের উদ্দেশ্যে সংস্কৃত ভাষায় লেখা দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের একটি চিঠি।
চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ নামক গ্রন্থে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান রচিত অনেকগুলি সংকীর্তনের পদ পাওয়া যায়। সুদীর্ঘ ১৩ বছর তিব্বতে অবস্থানের পর দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ৭৩ বছর বয়সে লাসা নগরের নিকটস্থ লেথান পল্লীতে ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। তাঁর সমাধিস্থল লেথান বর্তমানে তিব্বতিদের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৮ সালের ২৮ জুন অতীশ দীপঙ্করের পবিত্র চিতাভস্ম চীন থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকায় আনা হয় এবং তা বর্তমানে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে সংরক্ষিত আছে।
প্রিয় পাঠক, আমরা এতক্ষন ধরে অতীশ দীপঙ্করের জন্ম, শিক্ষা, কর্ম এবং মৃত্যু সম্পর্কে কিছুটা জানলাম। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যার সম্পর্কে এতক্ষন পড়লাম সেই মহামতি অতীশ দীপঙ্করের ব্যক্তিগত জীবন দর্শনটা আসলে কি রকম ছিল, উনি কি বিশ্বাস করতেন, কি বিশ্বাস করতেন না।
একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন দর্শনটা না জানলে, তাঁর সম্পর্কে জানাটা কেমন জানি অপূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল অতীশ দীপঙ্কর সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অধ্যয়নের ঘাটতির কারনে উনার জীবন দর্শনের ধারাটা সম্পর্কে আমি নিজেও খুব বেশী অবগত নয়। ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের গুরুদের সাথে অতীশ দীপঙ্করের তর্কযুদ্ধ হত।
বুদ্ধগয়ার বজ্রসান বিহারে সংগঠিত সেই রকম একটা ডিবেট/তর্ক সম্মেলনে তাঁর তীক্ষ্ন যুক্তিখন্ডন থেকে ব্যক্তিগত দর্শন সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা পেতে পারি। বিতর্ক সম্মেলনের সভাপতি স্থবির রত্নাকর বন্দনাসহকারে আচার্য দীপঙ্করকে বলেন- আপনি আপনার মতবাদ সম্পর্কে সর্বসম্মুখে প্রকাশ করুন। আপনি কোন মতাবলম্বী?
আচার্য দীপঙ্কর নমনীয় এবং বলিষ্ঠসুরে বলেন- আমি কোন মতবাদের অনুগামী নয়। আমি কেবল সত্যে অনুগত। এটা শুনে এক ব্রাহ্মণ পন্ডিত প্রশ্ন করেন- সেই সত্য কি রূপ। আচার্য বললেন, সত্যের কোন রূপ হয় না, ব্রাহ্মণ। সত্য সকল রূপ, সকল নাম কিংবা বুদ্ধিনিরূপিত সকল ধরনের সংজ্ঞার অতীত। মানুষ সত্যের এক একটি রূপ কল্পনা করে মাত্র। আর সত্যের উপর আরোপিত বা কল্পিত সেই সব রূপকেই মতবাদ বলে।
স্থান, কাল, পাত্রভেদে প্রতিটি মতবাদই প্রাথমিকভাবে উপকারী ও কার্যকরী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, কোনও মতবাদই সত্যের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে পারে না। যুক্তি প্রয়োগ করলে সমস্ত মতবাদই অন্তিমে খন্ডিত হয়ে যায়। তাই আমি কোনও মতের অনুগামী নয়, আমার কাজ হল সকল ধরনের মতবাদকে খন্ডন করা, স্থাপন করা আমার কাজ নয়। মূলত স্থাপন করার প্রয়োজনও নাই।
কারন সত্য যা, তা স্বয়ং প্রতিষ্ঠিত এবং তা কোন যুক্তির দ্বারা প্রমানিত হবার জন্য অপেক্ষা করে না।
এরপর তিনি সভায় উপস্থিত অন্যান্য পন্ডিতদের লক্ষ্য করে বলেন, আপনারা যে যেরূপ মতবাদকে সত্য বলে মানেন, তা বর্ণনা করুন- আমি আপনাদের তাবৎ মতবাদকেই খন্ডন করব।
জৈনক পিতবাস শ্রমন উঠে দাঁড়ালেন। আত্মপ্রত্যয়ী স্বরে তিনি আচার্যকে বললেন, কার্য-কারন শৃঙ্খলাকেই (Cause-effect Relation) আমি চরম সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। কারণ হতেই কার্যের উৎপত্তি হয়। বীজ থেকে যেমন বৃক্ষ, দুধ থেকে যেমন দধি, তিল থেকে যেমন তৈল। এই নিয়ম সর্বত্র সত্য।
আচার্য দীপঙ্কর শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন- ভালো কথা। এখন তবে আপনিই বলুন- এই কার্য ও কারণ বিষয় দুইটি কি এক নাকি ভিন্ন? শ্রমন বললেন- এরা পরস্পর ভিন্ন। আচার্য বলতে লাগলেন- বেশ। যদি কার্য ও কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়, তবে যেকোনো কারণ থেকে যেকোনো কার্যের উৎপত্তি হতে পারে। যেমন- বটগাছের বীজ থেকে আমগাছ জন্ম নিতে পারে। পানিকে প্রক্রিয়া করে দুধ বানানো যাবে। কিন্তু বাস্তবে এরূপ হয় না। অথচ কার্য ও কারণ সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভিন্ন হলে উক্ত বিষয়গুলো ঘটার সম্ভবনা ছিল।
ঠিক এই সময়, শ্বেতবাস অন্য এক ব্রহ্মচারী তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন- না, কার্য ও কারণকে আমি ভিন্ন মনে করি না। তারা বস্তুত এক। কার্য কারণের ভেতরই লুকায়িত বা বর্তমান থাকে। বীজের ভেতর বৃক্ষ, দুধের ভেতর দই, তিলের ভেতর তৈল পূর্ব থেকেই নিহিত থাকে। অঙ্কুরোদম, মন্থন বা পেষণের দ্বারা কার্যকে কারণের ভেতর থেকে বাহির করে আনা হয় মাত্র।
এই ধরনের যুক্তি শ্রবণ করার পর আচার্য দীপঙ্কর দ্বিমত পোষণ করে বলেন- কার্য যদি পূর্ব থেকেই কারণের ভেতর বিদ্যমান থাকে তবে আর নতুন করে কার্য উৎপন্ন হওয়ার কোন ভিত্তি নাই। কার্য ও কারণ যদি অভিন্ন/এক হয় তবে দই খাওয়ার ইচ্ছা হলে দইয়ের বদলে আমরা দুধ খেতে পারি কারণ দুধের ভেতর দই নিহিত আছে, গায়ে তেল মাখার ইচ্ছা হলে তিল গায়ে ঘর্ষণ করতে পারি কারন তিলের ভেতর তেল নিহিত আছে, লজ্জা নিবারণের নিমিত্তে কাপড় পরিধান না করে তুলা বা সুতা পরিধান করতে পারি কারন তুলা/সুতার ভেতর কাপড় নিহিত আছে।
এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই হু হু করে হেসে উঠলেন। একটু ইতস্তত হয়ে শ্বেতবাস ব্রহ্মচারী তথাপি বললেন- আমি ঠিক এই রকম বলতে চাইনি। আমি বলতে চাই কার্য ও কারণের মধ্যকার সম্পর্ক একও বটে, আবার ভিন্নও বটে। আচার্য বললেন-কার্য ও কারন একই সাথে ভিন্ন ও অভিন্ন এমন চিন্তা আসলে আলো ও অন্ধকারের একত্রে অবস্থানের মতন যা নিতান্তই অযৌক্তিক।
এরপর আচার্য বলতে লাগলেন, কার্য–কারণ শৃঙ্খলাকে পূর্ব থেকেই সত্য ধরে নিয়েই সকল দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং এই শৃঙ্খলার দ্বারা আমরা দৈনন্দিন ঘটনাসমূহ ব্যাখ্যা করে থাকি। অথচ কার্য–কারন প্রকৃতপক্ষে কোন যৌক্তিক শৃঙ্খলাই নয়। কার্য কারণের সহিত এক নয়, আবার ভিন্নও নয়। এদেরকে একই সাথে ভিন্ন ও অভিন্ন বলা যায় না অথবা একই সঙ্গে ভিন্নও নয়, অভিন্নও নয় বললে সবটাই ভুল বলা হয়।
সুতরাং কার্য–কারণ ভাবনার উপর স্থাপিত আমাদের তাবৎ লৌকিক, অলৌকিক, দার্শনিক আচার ও মতবাদ দিনশেষে অমূলক ও অযৌক্তিক হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমি কোনও মতবাদকেই পরম সত্য মনে করি না। কারণ এই বিশ্বজগতের কোনও বস্তুর স্বতন্ত্রসত্ত্বা /একক অস্তিত্ব নেই। সকলই পরস্পর নির্ভরশীল এবং সকলই পরতন্ত্র। এই জীবন একটা স্বপ্ন, আদিতে এই স্বপ্ন ছিল না, অন্তিমেও থাকবে না।
অতএব বর্তমানে যে জীবন অনুভব করছি, তারও কোন একক ও স্বতন্ত্র বন্ধন নাই, তাই নির্বাণও নাই। নির্বাণ যদি প্রত্যাশিত কোন বিষয় হয়, তবে তার শুরু থাকবে। আর যার শুরু আছে, তার শেষও থাকবে। শুরু ও শেষের অধীনস্ত নির্বাণ তাই দুঃখ থেকে মুক্তির চূড়ান্ত অবস্থান নয়।
দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখের নিবৃত্তি, নিবৃত্তির উপায় কোন কিছুরই স্বতন্ত্র সত্ত্বা নেই। তাই চতুরার্য সত্যকে পরম সত্য বলা যায় না। পরম অর্থে বুদ্ধ নাই, ধর্ম নাই, সংঘ নাই। এই জগত এবং জগতের সমস্ত ঘটনা স্বতন্ত্র সত্ত্বা শুন্য।
আচার্যের এই ধরণের কথা শুনে সভাপতি স্থবির রত্নাকর বললেন- এই জীবন, জগত, শ্রামন্য, সাধনা, বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ, এমনকি এই বিতর্ক সভা, সব কিছুই যদি শুন্য হয়, তবে শুন্যও কি নিরর্থক হয়ে যাবে না, দীপঙ্কর। প্রত্যুত্তরে আচার্য দীপঙ্কর বললেন- আমি শুন্য বলেছি মহাস্থবির, নিরর্থক বলিনি। এই জগতের কোন কিছুরই স্বতন্ত্র সত্ত্বা নাই, সকলই স্বতন্ত্রতা শুন্য, আমি শুধু এটাই বলেছি।
আমি কখনো বলিনি, এই জগত অলীক ও অর্থহীন। শুন্য মানে নেতিবাচক বা কিছুই নাই, বিষয়টা ঠিক এই রকম না। আমাদের দেহমন কিংবা চারপাশে যা আছে তাদের একক, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই। এরা একটি আরেকটির সাপেক্ষে অবস্থান করে। যেমন- আলো না থাকলে অন্ধকারের কোন অস্তিত্ব নেই, আবার অন্ধকার না থাকলে আলোর কোন স্বাধীন অবস্থান নেই।
তাই আলো-অন্ধকার মূলত শুন্য। জীবন আপাত দৃষ্টিতে কার্যনির্বাহের একটি ব্যবস্থামাত্র, যার একটা ব্যবহারিক সত্ত্বা/ ব্যবহারিক মূল্য আছে। সেই ব্যবহারিক এবং লৌকিক সত্ত্বাকে মেনে নিয়েই আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, আধ্যাত্মিক সাধনা, বুদ্ধগণের আবির্ভাব, সদ্ধর্মদেশনা, সংঘপ্রতিষ্ঠা, চতুরার্য সত্য, বোধিলাভ ইত্যাদি পরিচালিত হয়।
কিন্তু এইসব কোন কিছুই চরম ও পরম সত্য নয়। যা পরম সত্য, তাতে জগতের অনুপ্রবেশ নাই, বুদ্ধিনিরূপিত কোন সংজ্ঞা বা অভিধার অণুমাত্র স্পর্শ নাই। মরুভূমির ধু-ধু বালুকারাশির উপর ভ্রমবশত মরীচিকা দৃষ্ট হয়। কিন্তু মরীচিকায় দৃষ্ট কুয়ার পানি কোন পথিকের তৃষ্ণা মেটাতে পারে না।
পরমসত্য হল প্রপঞ্চশুন্য যা উৎপন্ন হয় না, ধ্বংস হয় না, তা শাশ্বত নয়, অশাশ্বতও নয়, এক প্রকার নয়, বহুপ্রকারও নয়, তাতে আগমন ও নির্গমন নেই। অতঃপর আচার্য অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের আলোচনা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার পূর্বেই উপস্থিত জনতার গুঞ্জন গর্জনে পরিণত হল, ছি ! ছি ! বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ, নির্বাণ, উপাসনা, চতুরার্য সত্য সব কিছুই মিথ্যা, সকল মতবাদ মিথ্যা? ছিঃ! এ নাস্তিক, নাস্তিক।
এনার বাক্য শ্রবন করাও মহাপাপ। সেই জনকোলাহলের ভেতর উক্ত সভার সভাপতি রত্নাকর মহাস্থবির দুই হাত প্রসারিত করে ক্ষুব্ধ জনতার গর্জনকে স্তম্ভিত করে দিয়ে বললেন- শান্ত হোন। এটা দার্শনিক বিচারসভা, ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশের স্থান নয়।
আচার্য অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান প্রবল যুক্তিসহকারে নিজ বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। আপনাদের ভেতর কারো সাহস থাকলে তাঁর বক্তব্যকে যুক্তি দ্বারা খন্ডন করুন। অন্যথায় নিজেদেরকে সংবরণ করুন। সমস্ত সভা নিঃশব্দ হয়ে গেল। কেউই সাহসভরে অগ্রসর হলেন না।
তথ্যসূত্র : অতীশ দীপঙ্কর, বাংলাপিড়িয়া ।
নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা, সন্মাত্রানন্দ ।