মোঃ ফাহাদ হোসেন ফাহিম
“একদিন মরতে হবেই, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যদি মরতে পারি, সে মরাতেও শান্তি আছে ”
ভোরের পাখি জাগে একাকী, ঠিক সূর্যোদয়ের আগে, গান গায় মনের আনন্দে, সূর্য ওঠার পর সে মুখ লুকোয় রাঙা মেঘেদের ডানায়। শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন ঠিক তেমনি। তবে অন্যসব পাখিরা স্বার্থের নধরদেহী জীমূতে যখন বিলীন, শেখ মুজিব তখন দেশপ্রেমের আগুনে খাক হওয়া ফিনিক্স পাখি। কারণ একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সাথে সম্পৃক্ত তা-ই তাকে ভাবিয়েছে গভীরভাবে। বাংলার জনসাধারণের দুর্দশায় তাঁর গভীর ও নিখাদ উদ্বেগ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান, ন্যায়ের পক্ষে অকুতোভয় সাহস তাঁকে আন্দোলন গড়ে তুলতে শক্তি জুগিয়েছে। তাঁর প্রেরণাদায়ী নেতৃত্ব, কঠোর সংকল্প, গতিশীলতা ও অভাবনীয় স্বতঃপ্রবৃত্ত শক্তি কোটি কোটি নর নারী এমনকি শিশু অনুসারী সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। তাইতো ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এদেশের জনগণ গভীর ভালোবাসায় তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। আর জেলে বসেও একজন মানুষ কতোটা ভালোবাসতে পারে তাঁর দেশ ও জাতিকে, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ না পড়লে কখনোই তা জানতে পারতাম না।
বই সম্পর্কিত তথ্য:
বইয়ের নামঃ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
লেখকঃ শেখ মুজিবুর রহমান
বইয়ের ধরনঃ আত্মকথা
পৃষ্ঠাঃ ৩২৯
মূল্যঃ ২২০ টাকা
প্রথম প্রকাশঃ জুন, ২০১২
প্রচ্ছদঃ সমর মজুমদার
প্রকাশনাঃ দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড
ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৪.৯/৫
বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং সহধর্মিণীর অনুরোধে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে শেখ মুজিব লিখতে শুরু করেন তাঁর আত্মজীবনী। ১৯৬৬ – ৬৯ দীর্ঘ চার বছর ধরে তিনি লিখেছেন অলঙ্কারশোভিত ঘনঘটাময় মহাকাব্যের অমর বিরচন। তবে শেষ করে যেতে পারেনি তাঁর নৈর্ব্যক্তিক কাব্যগাথা। ১৩২৬ বঙ্গাব্দে চৈত্র মাসের ৩ তারিখে পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা খাতুনের ক্রোড় আলোকিত করে ধরণীতে এসেছিলেন শেখ মুজিব। কৈশোর থেকেই ছিলেন টিমোথি পেনপোয়েমের মতো বিদ্রোহী আর গনতন্ত্রের মানসপুত্রের মতো অকুতোভয়। তাইতো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাতেই তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি। বংশপরিচয়, জন্ম, শিক্ষা ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বলতে বলতে তিনি থেমে গেছেন ১৯৫৫ তে। শেষ লাইনটি লিখেছেনঃ ‘তাতেই আমাদের হয়ে গেলো।’ কিন্তু আমাদের যে হয় না তাতে! আমরা আরও শুনতে চাই তাঁর সুখপ্রদ কাব্য। কারণ এ কাব্য যে একান্ত আমাদের, আমাদের রক্তে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস, আমাদের পতাকার লালে লীন হয়ে আছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র গল্প।
কাশফুলের শুভ্রতার মোহমুগ্ধ বাঁকে, মধুমতীর তীরে শেখ বোরহানউদ্দিন নামক এক ধার্মিক পুরুষ গোড়াপত্তন করেছিলেন শেখ পরিবারের। শেখ মুজিব স্থানীয় জমিদার ও নীলকরদের সঙ্গে তাঁর পূর্বপুরুষের প্রতিরোধ সংগ্রামের গল্প শুনে বড়ো হন। তাঁর বংশধর শেখ কুদরতউল্লাহ যখন ভুঁইফোঁড় ইংরেজ রাইনের বিরুদ্ধে ‘আধা পয়সা’ জরিমানা করে বলেছিলেন, ” টাকা আমি গুনি না, মেপে রাখি। টাকার আমার দরকার নাই। তুমি আমার লোকের উপর অত্যাচার করেছ; আমি প্রতিশোধ নিলাম “, তখন আমি বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে ভেবেছি তাঁর আত্মগৌরবের কথা। শেখ মুজিবও তাঁদের যোগ্য উত্তরাধিকারী, যিনি কখনোই আপোস করেননি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। নানা শেখ আবদুল মজিদ ও দাদা শেখ আবদুল হামিদ ছিলেন একই বংশের লোক। ছোট দাদা খান সাহেব আবদুর রশিদ কতৃক প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি এম ই স্কুলেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হোন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। ১৯৩৪ এ সপ্তম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় বেরিবেরি এবং ১৯৩৬ এ গ্লুকোমাতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পর ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে শুরু হয় তাঁর পড়াশোনা। ১৯৩৮ সালে তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সংসর্গ বদলে দেয় তাঁর রাজনৈতিক মনন। ১৮ বছর বয়স থেকেই শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন। রমাপদকে হত্যা চেষ্টার মিথ্যা মামলার জন্য এ বয়সেই প্রথম জেল খাটতে হয়েছিল তাকে।
ডানপিটে শেখ মুজিব পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও ছিলেন দূরন্ত। পেশায় মুন্সেফ আদালতের সেরেস্তাদার হলেও বাবা ছিলেন অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি, আর যেখানে গিয়েছেন মুজিব সেখানেই ছিলেন নেতা, শেষমেশ নেতৃত্ব দিয়েছেন একটা দেশ ও জাতির আত্মপরিচয় সৃষ্টিতেও। ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর ভর্তি হোন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। শুরু হয় সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে যুবক মুজিবের আত্মত্যাগে আমি অভিভূত হয়েছি। দেশ ও জাতির হিতে কাজ করতে গিয়ে কতটাই না কষ্ট করতে হয়েছে তাকে, একের পর এক নেমে এসেছে বিপদ। লিয়াকত আলী খান বলেছিলেন, “যো আওয়ামী লীগ কারেগা, উসকা শের হাম কুচাল দেংগা।”
কিন্তু পিতার দেয়া ‘sincerity of purpose and honesty of purpose’ এর শিক্ষা তাঁকে পরাজিত হতে দেয়নি। তাঁর পিতার অভয় বাণীতে মুজিব পেয়েছিলেন নতুন পথের দিশা; আমৃত্যু কাজ করেছেন দেশের জন্য। ১৯৪৪ সালে শহীদ সাহেব যখন তাঁকে বললেন, ” Who are you? You are nobody.” ছয় দফার হ্যামীলনের বংশীবাদক টগবগে মুজিবও তখন বলেছিলেন, ” If I am nobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I am somebody.” সত্যি সত্যিই তিনি প্রমাণ করেছিলেন সে কথা। প্রকৃতার্থে তিনি শুধু ‘somebody’ ই নন, তিনি হচ্ছেন বাঙালি জাতির ‘everything’. অবশ্য সোহরাওয়ার্দী যে আদর করে তাঁকে বলেছিলেন সেকথা, তা তিনি মনে রেখেছেন আজীবন। তাইতো ছিলেন তিনি বিরলপ্রজ দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী, আদর্শবাদী ও প্রত্যুৎপন্নমতি রাজনৈতিক নেতা, আপোষহীন জননায়ক, জিতেন্দ্রীয় বাঙালি শেরপা ও বাঙালি জাতির পিতা।
শেখ মুজিবুর রহমান সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে জয় করেছিলেন মানুষের মন। তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন সোহরাওয়ার্দীর উদার রাজনীতি। সেজন্য বারবার অপমানিত ও পরাজয়বরণ করতে হয়েছে শহীদ সাহেবকে৷ তাইতো শেখ মুজিব আমাদের উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ” উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়৷” তিনি দেখিয়েছেন যে, অন্ধ কুসংস্কার, অলৌকিক বিশ্বাস ও পরশ্রীকাতরতা হচ্ছে বাঙালির দুঃখের মূল কারণ। দৈনিক আজাদ কাগজের ভক্ত ছিলেন, প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজেদের ‘মিল্লাত’ কাগজও। ছিলেন ভ্রমণ পিপাসু, তাঁর অতীন্দ্ৰিয় পর্যবেক্ষণ আমাদের মুগ্ধ ও বিহ্বল হতে বাধ্য করে। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা প্রতিরোধে তাঁর সাহসিকতা ছিল চোখে পড়ার মতো। মৃত্যুর ভয় না করে কিভাবে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণে, তা শুধু তাঁর পক্ষেই করা সম্ভব ছিল। তাঁর অপ্রতিম ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ রাজনৈতিক জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও কর্মদক্ষতা তাই আমাদের জন্য আদর্শ।
স্বাধীন ও জনকল্যাণমুখী পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিলেন যারা, পাকিস্তান সৃষ্টির পর তাদের অবস্থা এই – ” এত তাড়াতাড়ি এরা আমাদের ভুলে গেল হক সাহেব। হক সাহেব হেসে দিয়ে বললেন, এই তো দুনিয়া!” শেখ মুজিব যখনই নায্য কথা বলেছেন, জনগণের অধিকারের কথা বলেছেন স্বার্থপর শাসক গোষ্ঠী তখনই জেলে আটকে রেখেছে তাকে।
কিন্তু ফিনিক্স পাখিকে কি আটকে রাখা যায়? ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ৪ঠা জানুয়ারি শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি স্লোগানকে ধারণ করে শেখ মুজিব গড়ে তুলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। অফিস করলেন ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে। এদিকে পাকিস্তান সরকার তাঁর উপর শুরু করে দিয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। তবুও থেমে থাকেননি শেখ মুজিব। ১৯৪৮ সালে গঠিত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে হরতাল পালনের সময় তিনি গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ হন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারীতে তিনি কারাগারে নিরাপত্তা আইনে বন্দী অবস্থায় ‘বাংলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ বলে পালন করা হবে, আর, তিনি জেল থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে অনশন করেন এবং ২১ শে ফেব্রুয়ারী মিছিলে গুলি চালানোর প্রতিবাদ করেন।
রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার মাধ্যমে সংগ্রাম করেছেন বাংলা ভাষার জন্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারসহ জেলও খাটতে হয়েছিল তাকে। তবুও আপোস করেননি মুজিব। তিনি ছিলেন সত্যিই মুজিব – অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাড়াদানকারী। তিনি প্রতিবাদ করেছেন কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে, ফলে জেল খেটেছেন ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে। তিনি প্রতিবাদ করেছেন অপরাজনীতির বিরুদ্ধে, পালন করেছেন জুলুম প্রতিরোধ দিবস। তারই ধারাবাহিকতায় তাকে যুগ্ম সচিব করে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গড়ে উঠে গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক সন্দীপন, শুরু হয় কঠোরতম জেল জুলুম। তবুও থামে না শেখ মুজিব। জেলে বসেই অনশন করেছেন মাতৃভাষার জন্য। নিজের দেশ ও জাতিকে সত্যিকারভাবে ভালো না বাসলে, কেউ কি এতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে! তিনি লিখেছেন, ” একদিন সকালে আমি ও রেণু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’, ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দুজনই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’ এমনিতে কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়! আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস। রাজনৈতিক কারণে একজনকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা আর তার আত্মীয়স্বজন ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে দূরে রাখা যে কত বড় জঘন্য কাজ তা কে বুঝবে? ”
শেখ মুজিবের জীবনী লেখার পটভূমি, বংশ পরিচয়, শৈশব, কৈশোর থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতা কেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং সেসব বিষয়ে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সুচারু বর্ণনা রয়েছে বইটিতে। বহুমাত্রিক এই বইটিতে আছে তাঁর কারাজীবন, পিতা মাতা, সন্তান সন্ততি, সর্বংসহা সহধর্মিণীর কথা, আছে তাঁর চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের কথাও।
শেখ মুজিবের মহাপ্রয়াণের উনত্রিশ বছর পর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে ফিরে তাঁর আদরের হাচু তাঁর লিখিত চারটি খাতা পেয়ে যেমন বেদনার মাঝেও খুঁজে পেয়েছিল আলোর দিশা, তেমনিভাবে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রতিটি বাঙালির জন্যও প্রদীপতুল্য। অসমাপ্ত আত্মজীবনী-ই আমাদের আত্মপরিচয়ের বুকের বাঁশরি। বইটি পড়তে গিয়ে বারবার আমার চপল মন তাই বলে উঠে, ” অন্তর হতে আহরি বচন, আনন্দলোক করি বিরচন। ” বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ” একটি বই পড়ার দুটি উদ্দেশ্য থাকা উচিত; একটি হল- বইটিকে উপভোগ করা; অন্যটি হল- বইটি নিয়ে গর্ব করতে পারা।” অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সংসর্গে এসে আমার দুটো উদ্দেশ্যই হয়েছে সফল। ‘বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে/ বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে’, সত্যিই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি পাঠ না করলে হুমায়ুন আজাদের কথাটি হয়তো অনুভব করতে সমর্থই হতাম না। এটি এমন একটি গ্রন্থ যার দিঘল পাতা জুড়ে দুর্দম্য সূর্য ওঠে, যার পাতায় পাতায় নধরকান্তি সুরভিত গোলাপ ফোটে। বইয়ের পাতাও যে দীপ্তিময় পাঞ্জেরী হয়ে পাঠককে স্বপ্ন দেখাতে জানে, সুখপাঠ্য এ বইটিই তার প্রমাণ।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ মূলত বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পথপ্রদর্শক। চিত্তহারী অথচ ক্ষুরধার, অপ্রত্যাশিত অথচ অনিবার্য, সরল অথচ বলিষ্ঠ শব্দচিত্রের আড়ালে শেখ মুজিব এঁকেছেন বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের ছবি। তাঁর দেশপ্রেম, উদারচিন্তা, নিষ্ঠা, মুক্তবুদ্ধি, সৎ সাহস, আত্মানুসন্ধান ও সাহিত্য লিরিকের মূর্ছনার মাধ্যমে প্রগতিশীল ও সার্বভৌম বাঙালি চেতনার আনুপুরবিক ভাস্বরতার যে পথ তিনি আমাদেরকে দেখিয়ে গেছেন, ভাব সত্যের বিদুৎ বিকাশে আজও তা সংকর্ষিত ও অনুরণিত করে আমাদেরকে।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তাই বাঙালির সংগ্রাম, পরিচয় ও মনীষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। বইটি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের বিরচন, বইটি তাঁর জাতির পিতার বিবরণ। বইটি আমাদের আত্ম বিকাশের রাজনৈতিক দলিল। তাই নিজেদের যারা বাংলাদেশি কিংবা মানুষ বলেও পরিচয় দিতে চান, তাদের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য। ইংরেজ কবি শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, ” এ জগতে কেউ কেউ জন্মগতভাবে মহান, কেউ মহত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন, আবার কেউ স্বীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করেন৷ ” আমার মতে, এই ৩টি বৈশিষ্ট্যই শেখ মুজিবের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
তাঁর ভাবনা ছিল আকাশচুম্বী আর অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু ছিল জনগণ। কালের পরম্পরায় মুসলিম লীগ ঘরানার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে সমমনা বয়োজ্যেষ্ঠ, বয়োকনিষ্ঠদের সার্বিক সহায়তায় প্রধান সংগঠক হিসেবে ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন প্রগতিশীল সংগঠনের। আজও তার সুবাতাস বইছে চারদিকে। ৫৫ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। এর মধ্যেই এতো আলো জ্বালিয়েছেন, এত সাড়া জাগিয়েছেন, এত কিছু অর্জন করেছেন – কল্পনাকেও হার মানায়।
নিজেকে উজাড় করে পৃথিবীকে অবাক করে দিয়েছেন। চারিদিকে জয়ের প্রতিধ্বনি। আঁধার দূরীভূত হয়ে কবির ভাষায় ‘এত আলো’। বাংলাদেশের পাখিরা যদি গান গাইতে পারত, তাহলে হয়তো মিষ্টি স্বরে গেয়ে উঠতঃ ‘এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে/ কী উৎসবের লগনে।’ প্রত্যাশিত বেদনার বিষয় পাখিদের কণ্ঠে ধ্বনি আছে, শিস আছে, সুরেলা শব্দ আছে, ওদের নিজস্ব গানও আছে। নেই কেবল প্রান্তিক মানুষের বন্ধু, বাংলা ও বাঙালিকে জাগানো সারথি, নেই দুঃখী মানুষের কণ্ঠস্বর, শেখ মুজিব। তবুও সোনার বাংলায় যখনই দেখা দেয় আঁধার, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র স্বর্গীয় দীপ্তি এসে নির্বাপিত করে দেয় অন্ধকারের পাহাড়।
প্রিয় উক্তিঃ
১) আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি।’ পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে।
২) যে ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত, তাদের মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নাই। আর যারা বাবা মায়ের স্নেহ আর আশীর্বাদ পায় তাদের মতো সৌভাগ্যবান কয়জন!
৩) অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা, ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনদিন একসাথে হয়ে দেশের কোন কাজ করতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।
৪) আমি চিন্তাভাবনা করে যে কাজটা করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করেনা তাদের ভুল ও হয়না।
৫) যে কোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনো কালে সহ্য করে নাই।
৬) মানুষকে ব্যবহার, ভালবাসা ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়, অত্যাচার, জুলুম ও ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না।
৭) মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে।
লেখক:
মোঃ ফাহাদ হোসেন ফাহিম
শিক্ষার্থী, দ্বিতীয়বর্ষ, পশুপালন অনুষদ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২
ইমেইলঃ fahadhosenbau@gmail.com